ঘরকে সবুজ ও স্বাস্থ্যকর করতে রাখুন 10 টি দারুন ইনডোর প্ল্যান্ট
“ঘরটা একটু অগোছালো থাক
উঠোনে একটু ধুলো
পাকা দেয়ালের কঠিন জ্যামিতি ভাঙতে
বন্য লতাটা তুলো । ” — প্রেমেন্দ্র মিত্র
কবির এই উপলব্ধি — শহুরে ইঁট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গলে বন্দি মানুষের উপলব্ধি । দিন দিন জীবন ক্রমশই যান্ত্রিক হচ্ছে । তাই আসুন আমাদের চার দেয়ালের মাঝে সবুজের ছোঁয়ায় একটা স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলি ।
আমি চারটি কারণ বলবো ঘরের ভেতরে কিছু ইনডোর প্ল্যান্ট এর ব্যবস্থা করতে। সেগুলি হল-
১. শৌখিনতা
২. দূষণ রোধ
৩. ফটো/ ভিডিও শ্যুট
৪. সৌন্দর্য্য সৃষ্টি
একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়, আমাদের ঘরের বায়ুতে বাইরের বায়ুতে থেকে নয় গুন বেশি দুষিত পদার্থ থাকে। তাই শৌখিনতা পাশাপাশি স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ইনডোর প্ল্যান্টের জুড়ি নেই । অনেকেই ফটো বা ভিডিও শ্যুট এর কাজ করেন — সেখানে ঘরের গাম্ভীর্যই পাল্টে দিতে পারে দু’ চারটে ইনডোর প্ল্যান্ট । কথা না বাড়িয়ে আসুন জেনে নেই সেরা দশটি ইনডোর প্ল্যান্ট যেগুলি অতি সহজেই ঘরের মধ্যে রাখা যায় ।
মানি প্ল্যান্ট :-
Greenskeeper , Grower, বা Lucky plant বলে পরিচিত এই গাছ খুবই পরিচিত । এর পরিচিতি air purifier হিসেবে । এর কয়েকটি প্রজাতি পাওয়া যায় । যে কোনো একটি প্রজাতি বেছে নিয়ে, উপযুক্ত পাত্র, মাটি নির্বাচন করে লাগিয়ে ফেলুন মানি প্ল্যান্ট । ঘরের টেবিলে, কর্নারে , ব্যালকনিতে , বা ঝুলন্ত অবস্থায় একে রাখা যায় । ঘরের ব্যাকটেরিয়া জীবাণু শোষণ করে , বাতাসে বিশুদ্ধ অক্সিজেন বাড়িয়ে দিয়ে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে এর জুড়ি নেই । 2.এরিকা পাম :- খুব জনপ্রিয় ও পরিচিত ইনডোর প্ল্যান্ট এরিকা পাম(Ereca palm)। এলার্জি ও বায়ু দূষণের থেকে রক্ষা পেতে এই ইনডোর প্ল্যান্ট লাগান । দরজার দুপাশে , জানালার পাশে , ব্যালকনিতে ঘরের কর্নারে খুব সুন্দর লাগে এই গাছ । উচ্চতায় দুই থেকে আট ফুট পর্যন্ত হতে পারে । খুব সুন্দর ভাবে সাজাতে পারলে এই গাছ ঘরের রূপ বদলে দেয় । তবে এর পাতায় মাঝে মাঝে ছত্রাকের আক্রমণ দেখা যায় । যখন কিন্তু আন্টি ফাঙ্গাল স্প্রে করতে ভুলবেন না ।
ব্যাম্বু:-
ইনডোর ব্যাম্বু বা সোজা বাংলায় বাঁশ গাছ । এটি লাকি ব্যাম্বু নামেও পরিচিত । চিনা ভাষায় ‘ফু গোয়ে ঝু’ নামে পরিচিত । ফু মানে লাকি বা সৌভাগ্য । গোয়ে মানে সম্মান ও শৌর্য । আর ঝু মানে ব্যাম্বু বা বাঁশ । ফেং স্যুই মতে এই ব্যাম্বু ঘরে রাখলে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি ঘটে । একদিকে সুন্দর দেখতে , অন্যদিকে এই গাছের সবুজ ঘরের বাতাসকে শুদ্ধ রাখে । অনেকগুলি প্রজাতির মধ্যে চাইনিজ ব্যাম্বু নামে পরিচিত গাছগুলি ছোট আকারের হয় । এরা খুব সহজেই কম পরিশ্রম ও পরিচর্যাতে ঘরে রাখা যায় । একটি কাঁচের পাত্রে সমন্য জলেই অনেকদিন রাখা যায় । এর থেকে অনেক সিস্টার প্লান্ট এর জন্ম হয় । তখন দেখতে ভারি সুন্দর হয় ।
পাথরকুচি:-
পাথরকুচি একটা পরিচিত গাছ । এর ভেষজগুণ অনেক । একটি ছোট্ট টব এ লাগিয়ে রাখুন । খুব কম যত্নেই পাথরকুচি গাছ হয়ে থাকে । একটি ম্যাচিওর পাতা থেকেই এর গাছ হয়ে থাকে । ঘরের আর্দ্রতা দূর করে ঘরকে স্বাস্থ্য সম্মত রাখে এই গাছ । সাধারণ সার মিশ্রিত মাটিতেই পাথরকুচি হয়ে থাকে । মাঝে মাঝে টবের মাটি আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে দিলে পাতাগুলি সুন্দর ভাবে ছড়িয়ে যায় আর দেখতেও ভালো লাগে ।
বনসাই :-
বনসাই একটা দারুন শিল্পকর্ম । বট, পাকুর রবার থেকে শুরু করে এখন নানান জাতের বনসাই অনলাইনে পাওয়া যায় । বনসাইয়ের মাটি তৈরি , পট নির্বাচন, ও পরিচর্যা আলাদা হয়ে থাকে । আগে বনসাই সম্পর্কে একটু জেনে নিন । তারপর গাছ কিনুন । বালি পাথর মিশিয়ে জৈব সার দিয়ে ভালো করে মাটি তৈরি করুন । আর বাড়িতে বনসাই করার শখ থাকলে দু তিন বছরের পরিকল্পনায় তৈরি করতেই পারেন । সে বিস্তারিত বিষয় জানতে হলে আমাদের জানান , পরের আর্টিকেলে লিখবো। ছবি তোলা , সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য বনসাইয়ের তুলনা হয় না । পাশাপাশি ভারী অক্সিজেন দেবার ব্যাপারে বনসাইয়ের জুড়ি মেলা ভার।
স্নেক প্ল্যান্ট বা সানসাভেরিয়া :-
এই প্ল্যান্ট অনেকটা তরবারির মত দেখতে । গাছটি কেনার সময় ডিপ সবুজ রং এর পাতা দেখে কিনতে হবে । আফ্রিকার কঙ্গো , নাইজেরিয়ায় এই গাছ পাওয়া যায় । গ্লোবাল যুগে এই গাছ চলে আসছে আমাদের ঘরে । গাছটির লম্বা পাতার জন্য এর একটি মজার ইংরেজি নাম আছে । সেটি হল – ‘ mother-in-law’s longue । পটিং মেশানো উপাদানে মাটি ছাড়াই একে লাগানো যায়। খুব বেশি জল দেবার প্রয়োজন নেই। ঘরের জলীয় বাষ্প শুষে নিয়ে ব্যাকটেরিয়া দূর করে বাতাসকে শুদ্ধ রাখতে এর তুলনা নেই ।
স্পাইডার প্ল্যান্ট :-
চোখ জুড়ানো অর্কিডের বিশেষ প্রজাতির গাছটি বেশি লম্বা হয় না । কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে । বেশি শুস্ক বা বেশি আর্দ্র পরিবেশে একে রাখা যাবে না । মাটি ও পটিং এর মিশ্রণে একে লাগালে খুব ভালো হয় । সরাসরি সূর্যালোক পৌঁছোয় না এমন স্থানে এই প্ল্যান্ট রেখে দিন । ঘরে সবুজ পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি শৌখিন মানুষের জন্য এই গাছ উপযুক্ত । চিকন লম্বা পাতা গুলিতে মাঝে মাঝে বিশুদ্ধ জল স্প্রে করে দিন । কয়েকদিন পর পর খুবই অল্প পরিমাণ জল দিন । ঘরের তাপমাত্রা শোষণ করে ঠান্ডা রাখে এই গাছ ।
মনস্টেরা ডেলিসিওসা :-
ম্যাক্সিকো এবং দক্ষিণ পানামায় এই গাছটি পাওয়া যায় । তবে এর সৌন্দর্যের জন্য ঘরে ঘরে এই গাছ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যারা ঘরে সবুজের সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধ বাতাসের ছোঁয়া চান , তাদের জন্য এই প্রজাতির গাছ উপযুক্ত । এই গাছটি “swiss cheese plant ” নামেও পরিচিত । গাঢ় সবুজ পাতার জন্য এর রূপ আলাদা সৌন্দর্য দিয়ে থাকে। এতে সপ্তাহে দু’বার জল দিতে হয় । সরাসরি সূর্যালোকে একে রাখতে নেই । পরিচর্যাতেও বেশি পরিশ্রম নেই । তাহলে অর্ডার করে ফেলতে পারেন এই ইনডোর প্ল্যান্টটি।
ফিগ:-
আসল নাম Ficus lyrata হলেও এর পরিচিত নাম Fiddle-leaf-fig tree । আফ্রিকার গরম আর আর্দ্র পরিবেশে এই গাছ হয়ে থাকে । খুব উপকারী আর বড় পাতায় সৌন্দর্য প্রকাশিত হলেও ঘরে এটি লাগানো একটু চ্যালেঞ্জিং । বাড়ির পরিবেশ যদি খুব গরম আর আর্দ্র হয়ে থাকে তাহলে আপনি এই গাছটি ইঁদুরের জন্য ভাবতেই পারেন । খুব বেশি ঠান্ডা বা অন্ধকার স্থানে এই গাছ রাখবেন না । বড় বড় পাতায় খুব সুন্দর সবুজের বাতাবরণ তৈরি করতে আর এখনকার বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে তাই ফিগ প্ল্যান্টের এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে ।
অর্কিডের প্রজাতি:-
সকলের কম বেশি প্রিয় ইনডোর প্ল্যান্ট হল অর্কিড । এত প্রজাতির অর্কিড এখন পাওয়া যায় যে , নাম করতে বসলে বই হয়ে যাবে । তাই পছন্দের অর্কিড দোকান থেকে বা অনলাইনে কিনে আনুন । তবে অর্কিড এর জন্য বেশি জল দেওয়া , বেশি খাবার দেওয়া অর্থাৎ কোনোকিছুই বেশি করা যাবে না । ডাল বা পাতা ছেঁটে দেওয়া বা গাছের গায়ে হাত লাগানো ইত্যাদি করা যাবে না । খুব আদুরে এই গাছগুলি অনেক রকম ফুল ফোটে । লাল নীল বেগুনি কমলা নানা রকম রং এর বৈচিত্রে ভরা অর্কিড ঘরে রাখতে পারেন । এই গাছগুলি বেদি লম্বা হয় না বলে সাইড টেবিলে , জানলার ধারে , কর্নার সেল্ফ এ সাজিয়ে রাখতে পারেন অনায়াসেই।
ইনডোর গাছগুলি লাগানোর আগে থেকেই পরিকল্পনা করে নিতে হবে । গাছগুলি লাগানোর পরেও কিছু পরিচর্যা অবশ্যই করতে হবে । ঘরে ভালোবাসার মানুষটির মতো তাকেও আদর যত্ন করতে হবে । তবে তার নিঃস্বার্থ সৌন্দর্য, উপকার পেতে থাকবেন ।
ইনডোর প্ল্যান্ট এর যত্ন হিসেবে খুব সংক্ষেপে মূল বিষয়গুলো তুলে ধরছি ।
1. মাটি :- শুকনো গোবর সার এর সঙ্গে জৈব সার মিশিয়ে মাটি তৈরি করুন । ওজন কমাতে কোকো পিট বা নার্সারিতে তৈরি মাটি নিয়ে আসতে পারেন । মাটি যেন বেশি ভেজা বা বেশি শুষ্ক না থাকে । রোদে শুকিয়ে মাটিকে জীবাণুমুক্ত করে নিতে ভুলবেন না ।
2. উপযুক্ত পাত্র :- মাটিকে উপযুক্ত পাত্র এমনভাবে ভরতে হবে, যাতে কমপক্ষে দের থেকে দুই ইঞ্চি উপরের দিকে ফাঁকা থাকে । যেহেতু ঘরের ভেতরে রাখতে হবে তাই পাত্রের নীচে ফুটো না করলেও চলে । সেক্ষেত্রে জল হিসেব করে দিতে হয় । সুন্দর মাটি, চিনামাটি , প্লাস্টিকের পাত্র কিনতে পাওয়া যায় । কোন গাছ লাগাবেন তার উপর পাত্রের আকার নির্ভর করবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর মাটি পাল্টাতে হয় । প্রথম দিকে বছরখানেক নতুন মাটিতেই চলতে পারে । তবে আঙুল দিয়ে মাটি মাঝে পরীক্ষা করে দেখতে হয়।
3. জল :- গাছ অনুযায়ী জল দেওয়া প্রয়োজন । রোজ একটু করে জল দিতে হয় । তবে বনসাই জাতীয় গাছে দু-তিন দিন পর পর জল দেওয়া ভালো । জল ওভারফ্লো করে দেওয়া যাবে না ।
4. স্থান :- ঘরের যে কোনো স্থানেই গাছ রাখা যায় । কিন্তু গাছের জন্যও বাতাস প্রয়োজন । সৌন্দর্যের পাশাপাশি খোলা বাতাস যেন পায় সেদিকটাও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন । দরজার দুপাশে, ঘরের টেবিলে , কর্নারে , ব্যালকনিতে বা ঝুলিয়ে রাখা যেতে পারে । তবে সেটা গাছের ধরণ অনুযায়ী হবে ।
5. পরিচর্যা :- বাড়ির সদস্যের মতো গাছেরও যত্ন নিয়মিত নেওয়া প্রয়োজন । মাঝে মাঝে রোদে কয়েক ঘন্টা রেখে দিতে হবে । পনের দিন বা এক সপ্তাহ পর পর করতে পারলে গাছ বেশি ভালো থাকে । ধুলো জমলে ভেজা নরম কাপড় দিয়ে পাতাগুলো মুছে দিতে হবে । গাছের খাবার মানে সার , জল ইত্যাদি পরীক্ষা করে দিতে হবে । মাঝে মাঝে শুকনো ডাল পাতা কেটে দিতে হবে । মাটিকে আলতো খুঁচিয়ে নরম করে দিতে হবে । আর পারলে মাঝে মাঝে স্থান পরিবর্তন করে দিলে ভালো হবে । কোনো প্রয়োজনে স্থানীয় নার্সারিতে যোগাযোগ করে পরিচর্যা করলে ভালো হয় ।
আশা করি বন্ধুরা, আজকের একটু অন্য ধরনের বিষয়টি ভালো লেগেছে । ভালো লেগে থাকলে খুব কাছের প্রিয়জনকে শেয়ার করতে ভুলবেন না । ফেসবুক পেজটি লাইক করে আমাদের সঙ্গে থাকুন । খুব ভালো থাকুন , সঙ্গে থাকুন । ততক্ষণে আমরা নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবার প্রস্তুতি নিই ।