স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন “এক ডানায় ভর করে পাখি উড়তে পারে না।” স্বামী বিবেকানন্দের এই উক্তি যে কতটা সত্য তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হল- বেগম রোকেয়া। মুসলিম সমাজে নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন বেগম রোকেয়া। ছেলেবেলা থেকেই তিনি রক্ষণশীল পরিবারে মুসলিম মেয়েদের পর্দার ঘেরাটোপের মধ্যে জীবন-যাপনের অসহনীয় কষ্টের সাথে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে আজীবন পর্দা প্রথা এবং মুসলমান নারী মহলের কষ্টের অনেক দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। এছাড়া নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :- এই মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া জন্ম গ্রহণ করেন বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলার উপজেলা মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ গ্রামে, ১৮৮০ খ্রীঃ। তাঁর পিতা ছিলেন জহিরুদ্দিন মহম্মদ আবু আলি সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ারা পাঁচ ভাই-বোন ছিলেন।
তৎকালীন সমাজ :- বেগম রোকেয়ার পিতা ছিলেন আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শী। তা সত্ত্বেও তিনি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিলেন। বেগম রোকেয়ার সমকালে পরপুরুষের কাছে মুসলিম নারীর মুখদর্শন ছিল সমাজ বিরুদ্ধ কাজ এবং পাপ। কাজেই অন্তঃপুরে চিকের অন্তরালে ও বাইরে বোরখার ঘেরাটোপে নিজেকে প্রায় সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলতে হত। তিনি পাঁচ বছর বয়সে তাঁর মা রাহাতুন্নেসার সাথে কলকাতায় এসে একজন মেম শিক্ষিকার কাছে বিদ্যাচর্চার সুযোগ পান কিন্তু তৎকালীন সমাজ এবং তাঁর আত্মীয়-পরিজনদের ভ্রূকুটির জন্য সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
শিক্ষা জীবন :- বাবার ভয়ে এবং সামাজিক কটুকথার ভয়ে তিনি বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারেন নি। তবে তিনি তাঁর বড় দাদা ইব্রাহীম এবং দিদি করিমুন্নেসার প্রেরণা এবং সহযোগিতায় বাংলা ইংরেজি শিক্ষালাভ এবং সাহিত্যচর্চা করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর বিবাহের পর স্বামীর কাছেও তিনি ইংরেজি শেখেন।
বিবাহিত জীবন :- ১৮৯৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন –এর সঙ্গে বেগম রোকেয়ার বিবাহ হয়। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তদুপরি তিনি সমাজ সচেতন, কুসংস্কার মুক্ত ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। স্বামীর সহযোগিতায় ও আগ্রহে বেগম রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড় ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। তিনি লেখাপড়ায় ও সাহিত্যচর্চায় নিজেকে আরও ব্যাপৃত করেন। বেগম রোকেয়া দুই কন্যার জননী ছিলেন। ইতিপূর্বে ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। বেগম রোকেয়া মাত্র ২৯ বছর বয়সে বিধবা হন।
জেনে রাখুন : ডঃ এ. পি. জে. আবদুল কালামের জীবন সংগ্রাম ও সফলতার কয়েকটি বাণী
সাহিত্যচর্চার সূচনা :- সাখাওয়াত হোসেনের অনুপ্রেরণায় তিনি ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্য জগতের গন্ডিতে পা রাখেন। এরপর একে একে লিখে যান ‘মতিচূর’ –এর প্রবন্ধ গুলো এবং ‘সুলতানার স্বপ্ন’ –এর মতো নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনী।
সাহিত্যকীর্তি :- বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই তিনি পারদর্শিতা হয়ে সাহিত্যচর্চা করেছিলেন। রোকেয়া তাঁর নারীবাদী চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ‘মতিচূর’ (১৯০৪ খ্রীঃ প্রথম খণ্ড এবং ১৯২২ দ্বিতীয় খন্ডে), -এ। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি এবং সৃজনশীল রচনার উদাহরণ হল- ‘সুলতানার স্বপ্ন’ (১৯০৫ খ্রীঃ), ‘পদ্মরাগ’ (১৯২৪ খ্রীঃ) ইত্যাদি। ইংরেজিতে লিখেছেন ‘Sultana’s Dream’। যাকে বিশ্বের মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে তাঁর লেখাগুলি ‘নবনূর’, ‘সওগাত’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য :- দেশের কল্যাণসাধন এবং নারী স্বাধীনতার মঙ্গলকার্যে রোকেয়া ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর প্রবন্ধ, গল্পের মধ্যে দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গ সমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর রচনার মাধ্যমে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপারে ও ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন- “শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া নারী মুক্তি সম্ভব নয়।” রোকেয়া অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বলেছেন এবং তিনি নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মান বোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
সাংগঠনিক কর্মকান্ড :- ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর তিনি ভাগলপুরে স্বামীর প্রদত্ত অর্থে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ স্থাপন করেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যু ও পারিবারিক কারণে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় আসার পর ১৯১১ সালের ৫ মার্চ মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে স্থাপন করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। বর্তমানে এই বিদ্যালয় পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বালিকা বিদ্যালয়। এরপর ১৯১৬ সালে তিনি ‘নিখিলবঙ্গ মহিলা সমিতি’ বা ‘আঞ্জুমন-ই খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।
স্মৃতি ও সম্মাননা :- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’কে ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে স্মরণে রেখে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ নাম দেন। এছাড়াও নারী সমাজে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে’র ছাত্রীদের আবাসনের নামকরণ করা হয় ‘রোকেয়া হল’।
১৯৩২ খ্রীঃ ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পূর্ব সময়েও তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে প্রবন্ধাংশ লিখেছিলেন। তাঁর কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত, যা পরবর্তীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক অমলেন্দু আবিষ্কার করেন। মানব কল্যাণকর কাজ ও স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি যে মহান কীর্তি রেখে গেছেন, তাতেই তিনি অমরত্ব অর্জন করেছেন। দেশবাসীর হৃদয়ে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখাটি ভালো লাগলে সকলের সাথে শেয়ার কর। এরকম লেখার আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে যুক্ত থাকো।
This Article Is Written By
দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠরতা ছাত্রী
ভালো লাগে বই পড়তে , গান শুনতে , অভিনয় করতে ।
ভবিষ্যতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন । পিছিয়ে-পড়া নারী সমাজের মধ্যে চেতনার জাগরণ ঘটতে দেখার বাসনা ।