গাজর খাওয়ার কিছু উপকারিতা ও অপকারিতা
শীতকালে বাজারে অনেক ধরণের সবজি পাওয়া যায়। তার মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি সবজি হল গাজর।গাজরের ইংরেজি নাম ‘ক্যারট’। গ্রিক শব্দ ক্যারট-অন থেকে এই ক্যারট শব্দের উৎপত্তি। গাজর এর বৈজ্ঞানিক নাম Daucus carota। গাজর কে বলা হয় সুপার ফুড। খাদ্য উপাদান গুলোর মধ্যে এটি খুব শক্তিশালী। গাজর প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়। তবে এশিয়া মহাদেশে এর প্রচলন বেশি। কারন পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক গাজরই চীন দেশে উৎপাদিত হয়।
গাজর সাধারণত পাঁচটি বর্ণের হয়ে থাকে – সাদা, কমলা, বেগুনি, হলুদ ও লাল। গাজর পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি সবজি। এতে রয়েছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-কে, এবং ভিটামিন-বি, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড, ফোলেট, পটাসিয়াম, আয়রন, প্রচুর পরিমানে ফাইবার এবং বিটা ক্যারোটিন সহ পুষ্টিকর উপাদান যা শরীরে সঠিক পুষ্টির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। বিভিন্ন গবেষণায় জানা গিয়েছে, গাজর মানুষের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এখানেই শেষ নয়, ত্বক কে উজ্জ্বল করা থেকে শুরু করে ক্যানসার প্রতিরোধ করা — সব ক্ষেত্রেই উপকারী এটি। গাজর কাঁচা অথবা রান্না দু’ভাবেই খাওয়া যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যদি গাজর থেকে সর্বোচ্চ পুষ্টিটা পেতে হয় তবে কাচা গাজর খাওয়াই সর্বোত্তম। তাই গাজরের জুস বানিয়ে খেলেই পাওয়া যাবে গাজরের সর্বোচ্চ পুষ্টি উপাদান। তবে যেকোনো খাদ্য অতিমাত্রায় গ্রহণ করলে দেখা দিতে পারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তাই আজ আমরা গাজর খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে যেমন আলোচনা করবো তেমনি থাকবে গাজর এর অপকারিতা নিয়ে কিছু কথা। প্রথমে জানবো গাজরের উপকারিতা সম্পর্কে।
ক্যালোরি | 25 Kcal |
কার্বোহাইড্রেট | ৬ গ্রাম |
ফাইবার | ২ গ্রাম |
শর্করা | ৩ গ্রাম |
প্রোটিন | ০.৫ গ্রাম |
শরীরের প্রতিদিনের প্রয়োজনের ভিটামিনের অনেকটাই পাওয়া যেতে পারে গাজর থেকে :-
ভিটামিন | নিত্য প্রয়জনের কত % |
Vitamin A | 73% |
Vitamin K | 9% |
Potassium & Fiber | 8% |
Vitamin C | 5% |
Calcium | 2% |
নিয়মিত গাজর খেলে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পায়। গাজরের মধ্যে থাকা বিটা ক্যারোটিন যা লিভারে প্রবেশ করে ভিটামিন এ তে বদলে যায়। এটি পরবর্তী কালে চোখের রেটিনায় পৌঁছে দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। আর আমরা জানি চোখ ভালো রাখতে ভিটামিন এ কতটা কার্যকরী। বিটা ক্যারোটিন দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি চোখের অন্যান্য সমস্যা, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস ইত্যাদির মতো সমস্যায় বাধা দেয়। তাই চোখ ভালো রাখতে নিয়মিত গাজর খেতে পারেন।
ক্যান্সার প্রতিরোধে গাজরের তুলনা নেই। আমেকিরান জার্নাল অব ক্যানসার রিসার্চ এর মতে, গাজরে থাকা বেশ কিছু উপাদান ক্যান্সারের সম্ভাবনা গুলিকে দূরে রাখে। খাদ্য গ্রহণের পর হজম প্রক্রিয়া শেষে খাদ্যের যে উচ্ছিষ্টাংশগুলো আমাদের শরীরে থেকে যায় সেগুলোকে বলা হয় ফ্রি র্যাডিকেলস বা মৌল। এই ফ্রি র্যাডিকেলস শরীরের কিছু কোষ নষ্ট করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার এই ধরনের মৌলের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ফলে শরীরে ক্যান্সারের কোষ কম উৎপন্ন হয়। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি ১০০ গ্রাম গাজরে ৩৩ শতাংশ ভিটামিন ‘এ’, ৯ শতাংশ ভিটামিন ‘সি’ এবং ৫ শতাংশ ভিটামিন ‘বি-৬’ পাওয়া যায়। এগুলো এক হয়ে ফ্রি র্যাডিকেলসের সঙ্গে লড়াই করে। তাই নিয়মিত গাজর খেলে স্তন ক্যানসার, কোলন ও ফুসফুস ক্যানসারের সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়।
ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে গাজর- এর ভূমিকা অতুলনীয়। গাজর ত্বককে ভেতর থেকে সুস্থ ও সজীব রাখে। কারণ এর মধ্যে রয়েছে বিভমিন ‘এ’ , ভিটামিন ‘সি’, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পটাশিয়ামের মতো খনিজ উপাদান যা ত্বকের সুন্দর করে এবং ত্বকে সূর্যের তাপের কারণে যে সানবার্ন বা ট্যান পরে তা থেকে মুক্ত করতে পারে। এছাড়াও ত্বকের টান টান অবস্থা ধরে রেখে বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে।
মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে হার্ট বা হৃদপিণ্ড একটি জরুরী অঙ্গ। আর এই হার্ট সুস্থ রাখতে গাজর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন, আলফা ক্যারোটিন এবং লুটিন জিজানথেন যা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।এই উপাদানগুলো রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য ধমনীর ওপর কোনো আস্তরণ জমতে বাধা দেয় এবং হার্টকে সুস্থ ও সতেজ রাখে। তাই হার্ট সুস্থ রাখতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় গাজর রাখতে ভুলবেন না।
হাই ব্লাড প্রেসার কমাতে গাজর এর জুড়ি মেলা ভার। গাজরের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম যা হাই ব্লাড প্রেসার কমাতে সাহায্য করে। তাই উচ্চ রক্তচাপ কমাতে এবং শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত এবং পরিমাণ মত গাজর খেতে পারেন।
গাজরে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা মানব শরীরের হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। যারা খাবারে প্রতিদিন বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার খান তাদের হার্টের বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকি কমে যায়। এর ক্যারোটিনয়েডগুলো হৃৎপিণ্ডের নানা অসুখের ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তাই স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে এখন থেকে খাদ্যতালিকায় গাজর যোগ করুন।
যারা অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহ সবজি গ্রহণ করা বিশেষ জরুরি। আর গাজরে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়ামসহ নানা খনিজ উপাদান। যা হাড়কে সুস্থ ও মুজবুত রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
শরীরে লিভার অনেক ধরণের হরমোন নির্গত করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাজরে প্রচুর পরিমাণে দ্রবণীয় ফাইবার থাকে, যেসব ফাইবার পেটকে পরিষ্কার রাখে । পেটে শক্ত কঠিন মল জমতে দেয় না । মলত্যাগের বেগ সৃষ্টি করে লিভার ও কোলনকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। যদি প্রতিদিন একটি করে গাজর খাওয়া যায় তাহলে লিভারে বিভিন্ন সমস্যা , ও নানারকম সংক্রমণের হাত থেকে যেমন- হেপাটাইটিস, সিরোসিস ,কোলেস্টেসিস ইত্যাদি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। লিভারে জমা পিত্ত এবং শক্ত কঠিন ফ্যাটকে কমাতেও সাহায্য করে গাজর। যারা দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে চান , তারা গাজরকে আজই খাদ্য তালিকায় আমন্ত্রণ জানান।
সুস্থ ও পরিষ্কার দাঁত পেতে হলে নিয়মিত গাজর খান। গাজরের মধ্যে থাকা মিনারেলগুলো দাঁতকে সুস্থ ,সুন্দর ,পরিষ্কার ও মুজবুত রাখতে সাহায্য করে।এছাড়া গাজর খাওয়ার সময় আমাদের মুখে ‘সিলভা’ নামক একটি যৌগের নিঃসরণ ঘটে। এই যৌগটি দাঁতের ক্ষয়ের জন্য দায়ী ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংস করে মুখের ভেতর অ্যাসিডের ভারসাম্য বজায় রাখে।
সহজলভ্য সবজি গাজরে একদিকে ক্যালোরি যেমন কম থাকে , তেমনি সুগারের উপাদানও তুলনায় খুব কমই থাকে। আর ডায়াবেটিস রোগীর প্রধান সমস্যা হল সুগার , ফ্যাট আর কোলেস্টরেল । সেক্ষেত্রে গাজরে সুগার কম থাকায় অন্য সবজির থেকে বেশি উপকার করে। গাজরে থাকে বেশি পরিমাণ পটাশিয়াম এবং এমন কিছু খনিজ যা কোলেস্টেরল এবং ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গাজরের পুষ্টিমূল্য অপরিসীম।
গাজরের মধ্যে উপস্থিত ভিটামিন C যা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী। গাজরের মধ্যে থাকা বিভিন্ন উপাদান শরীরের ক্ষতিকর জীবাণু, ভাইরাস এবং বিভিন্ন ধরনের প্রদাহের বিরুদ্ধে কাজ করে। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে প্রতিদিন এক গ্লাস গাজরের জুস খেতে পারেন।
গাজরে থাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম যা গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের হাড়ের বিকাশে সাহায্য করে। এই অবস্থায় মায়ের শরীরের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। কারণ একই শরীরে দুজনের বিকাশ ঘটে । তাই গাজরে থাকা সমস্ত কার্যকর ভিটামিন ও উপাদানগুলো সন্তানের সঙ্গে মায়েরও খেয়াল রাখতে সাহায্য করে । গর্ভাবস্থায় মায়ের রক্তাল্পতা , পেশির খিঁচুনি ধরা, ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যার আশু সমাধান দিতে পারে গাজর ।
যে কোনো জিনিস খুব কার্যকর হলেও তার সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ না হলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য । তাই সঠিক সময় সঠিক পরিমানে গাজর খেতে হবে । মাত্রাতিরিক্ত গাজর খেলে কিছু অপকার হতে পারে । সেগুলি অবশ্যই মনে রাখা দরকার।
১. প্রচন্ড গরমে বেশি পরিমাণে গাজর খেলে অনিদ্রার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা যাদের তাদের মাত্রাতিরিক্ত গাজর রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।
২. অতিরিক্ত গাজর খেলে অল্প বয়সী শিশু যাদের নরম দাঁত বা দুধ দাঁত তাদের দাতের ক্ষয় দ্রুত ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
৩. গাজর কিংবা যে কোনো সবজি বা ফল বেশি পরিমানে খেলে বদ হজম , গ্যাস, অম্বল কিংবা ডাইরিয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৪. অতিরিক্ত গাজর খাবার ফলে মানুষের অন্ত্রে অতিরিক্ত বিটা ক্যারোটিন জমে যেতে পারে। এই অতিরিক্ত বিটা ক্যারোটিন ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
৫. অন্যান্য খাবারের পরিমানের সঙ্গে সাযুজ্য না রেখে গাজর খেলে শরীরের বিভিন্ন অংশ , বিশেষ করে হাত , পা, গালের চামড়ার রঙ জন্ডিস আক্রান্ত রোগীর মত হলুদ হয়ে যেতে পারে।
৬. অনেকের অ্যালার্জি থাকে গাজরে । তাই তাদের জন্য খুব সতর্ক হয়ে খাদ্য তালিকায় গাজরের ব্যাবহার করতে হবে ।
সবচেয়ে উপকারী জিনিসও অতিরিক্ত ও ভুলভাবে প্রয়োগে ক্ষতি করতে পারে। তাই গাজর এর উপকারিতার কথা মাথায় রেখেই নিওমিত গাজর খাবেন যেমন , তেমনি ভালভাবে জেনে নিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতেও ভুলবেন না । আশা করি আজকের আর্টিকেলটি খুব কাজে লাগবে সকলের । এরকম আরও লেখা পড়তে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক করে সঙ্গে থাকুন। আর কোন কোন বিষয়ে লেখা পড়তে চান , কমেন্ট করে জানান। আর হ্যাঁ , যদি লেখাটি একটুও ভালো লেগে থাকে তাহলে বন্ধুদের শেয়ার করতে ভুলবেন না । ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন । প্রেরণাজীবন আপনার সঙ্গে আছে ও থাকবে।