মোটিভেশন

শত বাঁধা পেরিয়ে যারা আজ বিজয়ী

6 Minute Read

কখনও কখনও ব্যর্থতা আর হতাশা আমাদের এমনভাবে ঘিরে ধরে যে , মনে হয় আর এগোনো সম্ভব নয়। মনে হয় সফল হওয়া অসম্ভব। কিন্তু যারা দাঁতে দাঁত চেপে ক্রমাগত তাদের স্বপ্নপূরণের দিকে এগিয়ে যায় , শত বাঁধাও তাদের হার মানাতে পারে না । প্রত্যেকটা ব্যর্থতাকে সিঁড়ি করে তাঁরা এগিয়ে যেতে থাকে তাদের গন্তব্যে । টম ওয়াটসনের ভাষায় , ” যদি সফল হতে চাও তবে ব্যর্থতার হার দ্বিগুণ করে দাও।” ইতিহাস হাতড়ালে দেখা যায় যে , সমস্ত সাফল্যের কাহিনীর পিছনে আছে ব্যর্থতার কাহিনী। কিন্তু সফলতা লাভের পর ব্যর্থতা , মানুষের নজরে পড়ে না । সবাই ভাবে ইশ্ লোকটা কত ভাগ্যবান , ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ছিল বলেই আজ সফল হয়েছে । গল্পটা কিন্তু উল্টো,বরং শত বাঁধা পেরিয়ে আজ তারা বিজয়ী হতে পেরেছে । প্রতিটি ব্যর্থতা যাদের সাফল্য লাভের জন্য উজ্জীবিত করেছে , পরাস্ত হয়েও যারা পিছিয়ে না পড়ে সামনে এগিয়ে গেছে তাদেরই গল্প আজ বলব তোমাদের ।

টমাস আলভা এডিসন

Image Source : Wikipedia

একদিন কানে আংশিকভাবে কালা চার বছরের এক বাচ্চা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলো তার মাষ্টারমশাইয়ের দেওয়া একটি ছোট্ট চিঠি নিয়ে । চিঠিটি মাষ্টারমশাই তার মাকে লিখেছিলেন এবং বলেছিলেন এই চিঠিটা যেন তার মা-ই পড়ে । তাতে লেখা ছিল ” আপনার টমি এত বোকা যে তার পক্ষে লেখাপড়া শেখা সম্ভব নয় , তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিন । টমির মা সেদিন টমিকে কিছু জানায় নি বরং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন _”আমার টমি মোটেই বোকা নয় , আমি তাকে নিজেই পড়াব।”
সেই টমিই আজ বিখ্যাত টমাস এডিসন নামে পরিচিত । এডিসন মাত্র তিন মাস স্কুলের শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং তিনি ছিলেন আংশিক বধির।

বিশ্বকে আলোকিত করার কারিগর তিনি । বৈদ্যুতিক বাতি সহ গ্রামোফোন,মোশন পিকচার ক্যামেরা এমন অনেক কিছু আবিস্কার করেছেন তিনি, যার নিদর্শন চারপাশে তাকালেই পাওয়া যাবে । কিন্তু এই বিখ্যাত বিজ্ঞানীকেও অনেক হতাশা ও ব্যর্থতার সন্মুখীন হতে হয়েছিল। যখন তিনি বৈদ্যুতিক বাল্ব তৈরির জন্য চেষ্টা করেছিলেন তখন কমবেশি তাকে ১০০০ বার ব্যর্থ হতে হয়েছিল কিন্তু এই ব্যর্থতা তাকে হার মানাতে পারে নি । এই সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন__

I don’t fail 1000 times, the light bulb was an invention with 1000 steps.

১৯১৪ সালে ৬৭বছর বয়সে টমাস এডিসনের কয়েক মিলিয়ন ডলারের কারখানা আগুনে বিনিষ্ট হয়ে যায় । কারখানাটির বীমা করা ছিল না। তখন বয়স্ক এডিসন দেখলেন তার জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি ভষ্মে পরিণত হল । কিন্তু হার মানা তাঁর স্বভাব নেই । তিনি মনে মনে বললেন যে , __ ” বিপর্যয়ের মধ্যে একটা মহৎ শিক্ষা আছে , আমাদের সমস্ত ত্রুটি বিচ্যুতি পুড়ে ছাই হয়ে গেল । ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমরা আবার নতুন করে শুরু করবো । “
টমাস এডিসন ভেঙে পড়তে পারতেন ভাবতে পারতেন তাঁর জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা বিফল হয়ে গেল, তিনি ধ্বংস হয়ে গেলেন ইত্যাদি। কিন্তু তিনি তা ভাবেন নি বরং নেতিবাচক দিকটার মধ্যে ইতিবাচক বিষয়গুলি দেখতে পেলেন এবং পুনরায় শুরু করলেন।

কর্নেল হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স

Image Source : Wikimedia

হারল্যান্ড স্যান্ডার্স বা কর্নেল স্যান্ডার্স যিনি চির স্মরণীয় হয়ে আছেন ” কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন” বা ‘কে এফ সি ‘ ফ্রাঞ্চাইজির জন্য। এই মানুষটির জীবনে ছিলো ব্যর্থতা ও হতাশার কালো অন্ধকারে ভরা । একসময় জীবনের সব আশা ছেড়ে দিয়ে স্যান্ডার্স আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় । কিন্তু সে সময় সে ফিরে তাকায় তাঁর জীবনের অর্জন গুলোর দিকে তখন তাঁর মনে হয় জীবনে এখনো তাঁর অনেক কিছু করার বাকি আছে । তিনি জীবনে অনেক হার দেখেছিলেন কিন্তু সেই হার তাকে সাফল্যের পথে এগোতে বাঁধা দিতে পারে নি। তাইতো ৬৫ বছর বয়সে তিনি শুরু করেন এক নতুন অধ্যায়ের। একটি ঝড়ঝড়ে গাড়ি এবং সরকারের সামাজিক সুরক্ষা বিভাগ থেকে দেওয়া ১০০ ডলার নিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। সেই থেকে শুরু হলো তার জীবনের নতুন অধ্যায়। তার মায়ের কাছে শেখা রন্ধন প্রণালী অনুযায়ী কিছু খাবার তিনি ফেরি করতে বের হলেন। কতগুলো বাড়ি ও রেস্তোরাঁ ঘোরার পর তিনি তাঁর প্রথম খদ্দের পেয়েছিলেন? গননা করে দেখা গেছে যে প্রায় ১০০০ টি ঘোরার পর তিনি তাঁর প্রথম খদ্দের পান । আমরা হলে হয়তো ৫টা কিংবা ১০টা খুব বেশি হলে ১০০টা বাড়ি ঘোরার পর হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতাম । বলতাম অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না । কর্নেল স্যান্ডার্স কিন্তু ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। বুড়ো বয়সে এসেও তিনি ব্যর্থতার কাছে হার স্বীকার করেন নি বরং ব্যর্থতাই স্যান্ডার্সের কাছে পরাজয় বরণ করেছে। আজ সারা বিশ্বে KFC একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে । বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুড চেইন KFC এর রয়েছে 20,000 শাখা , সারা বিশ্বে ১২৩ টিরও বেশি দেশে । আমরা KFC রেষ্টুরেন্ট গুলোতে যে বৃদ্ধ লোকের ছবি দেখতে পাই সেটি আর কেউ নন , কর্ণেল সান্ডার্স নিজেই ।

ওয়াল্ট ডিজনি

Image Source : Wikipedia

বিখ্যাত কার্টুন ক্যারেক্টার মিকি মাউসের সৃষ্টিকর্তা ওয়াল্ট ডিজনিকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক দুর্গম পথ । মুখোমুখি হতে হয়েছে কঠোর বাস্তবতার সঙ্গে । তিনি অত্যন্ত গরীব পরিবারে জন্মেছিলেন । ভোর হতে না হতেই সংবাদপত্র নিয়ে ছুটতেন এপাড়া থেকে ওপাড়ায়। তিনি অনেক খবরের কাগজের সম্পাদকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত ও হয়েছিলেন। একবার Kanasas City star নামক পত্রিকার সম্পাদক তাঁকে এ পত্রিকার চাকরি থেকে বহিস্কার করেন এই অজুহাতে যে ,
“তাঁর মধ্যে কোন প্রতিভা নেই , তাঁর কল্পনা শক্তির ঘাটতি রয়েছে ।”
ডিজনির শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি অত্যন্ত ঝোঁক দিল। বড় হতে হতে একসময় একজন চিত্রশিল্পী হওয়ার বাসনা তৈরি হয় তাঁর মনে । একবার গির্জার এক পাদ্রী তাঁকে কিছু ব্যঙ্গচিত্র আঁকার ফরমাস করেন । ডিজনি গির্জার কাছে একটা ছোটো চালাঘরে বাসা বেঁধেছিলেন, যেখানে অনেক ইঁদুর ঘোরাফেরা করত ।একটি ইঁদুর দেখে তার ভালো লাগে এবং যেটি শেষপর্যন্ত তাঁর বিখ্যাত ‘মিকি মাউস’ এ পরিণত লাভ করে । কিন্তু তাঁর জীবনের যাত্রা পথটা সহজ দিল না ।তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে খাওয়া পড়ার মতো টাকা তাঁর কাছে থাকত না । পরিবেশকরা তাঁর আইডিয়াকে খুব বাজে ভাবে প্রত্যাখ্যাত করত। কিন্তু নিজের আইডিয়ার উপর তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাই আর কিছু না ভেবে নিজেই উদ্যোগী হয়ে দুটি কার্টুন ফিল্ম তিনি বানিয়ে ফেলেন । কিন্তু এইসব চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল । কিন্তু তিনি কখনও ভেঙে পড়েন নি বরং স্বপ্নে উড়ান দেওয়ার জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়েছেন অনবরত। অবশেষে মিকি মাউসের প্রদর্শন হয় । মিকি মাউস যা পরবর্তীতে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম নিদর্শন হিসাবে জায়গা করে নেয় । ২২ টা পুরষ্কার জয় করে তাঁর এই ফিল্ম ।মিকি মাউসের মত তাঁর আরেকটি চোখ ধাঁধানো আবিষ্কার হল ডিজনি ল্যান্ড । এটিতে ডিজনি তাঁর কল্পনার জগতকে বাস্তবে রুপদান দিয়েছেন। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যানা হেইমে প্রতিষ্ঠিত এ থিম পার্কটির উদ্বোধন হয় ১৯৫৫ সালের ১৭ জুলাই । যেই স্থানটির সৌন্দর্যে অভিভূত হতে হাজার হাজার মানুষ রোজ সেখানে ভিড় করে। ডিজনি অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও তিনি তাঁর স্বপ্নকে পূরণ করেছেন ।

জে-কে-রাউলিং :

Image Source : Wikimedia

জনপ্রিয় কল্পকাহিনী হ্যারি পটার সিরিজের রচয়িতা জে-কে রাউলিং, যিনি ইতিমধ্যেই তাঁর রচনার মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের মন জয় করেছেন। এই সাফল্য তাঁর দুয়ারে এনে দিয়েছে খ্যাতির মর্যাদা। কিন্তু এই সফলতার পিছনে গল্পটা খুব একটা সুখকর ছিল না । জীবনের নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে । এমন ও অনেক দিন তাকে কাটতে হয়েছিল যখন তাঁর কাছে খাওয়া পড়ার মতো সম্বলটুকু ছিলো না। তবুও তিনি তাঁর স্বপ্নের পেছনে ছুটে গেছেন । বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরেও তিনি হাল ছাড়েননি বরং ব্যর্থতাকে বুকে টেনে নিয়েছেন ভালোবেসে । ব্যর্থতাকে প্রেরণার সিঁড়ি হিসাবে ধরে তিনি নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটেছেন ধূমকেতুর তীব্রতায় । ছোটোবেলা থেকেই রাউলিং গল্প পড়তে ও লিখতে ভালোবাসতেন । ইংরেজি নিয়ে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও বাবা মার সমর্থন না থাকায় তাঁকে পড়তে হয়েছিল আধুনিক ভাষা নিয়ে কিন্তু শেষমেষ তিনি এই বিষয় নিয়ে পড়েননি। একদিন তিনি ট্রেনে চেপে ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনের পথে যাচ্ছিলেন সেই সময় তার মাথায় আসে হ্যারি পটার গল্পের ধারনা । কিন্তু সেই সময় তাঁর মায়ের মৃত্যুর ঘটনা তাকে শোকাহত করে তোলে । যার প্রভাব পড়ে তাঁর লেখাতেও । ২৭ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন, তার সংসার জীবন ও ভালো কাটে নি । ফলে বছর খানেকের মধ্যে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে । তখন তাঁর কোলে ছিল ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান। তাকে নিয়ে অনেক কষ্টে তিনি দিন গুজরান করেন । বিষন্নতা ও হতাশা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যে একসময় তিনি আত্মহত্যার চিন্তা করেন । কিন্তু তিনি হার মানেন নি যন্ত্রণার কাছে । দুঃখ ও যন্ত্রণা গুলিকে কাজে লাগিয়ে তিনি এগোতে থাকেন নিজের স্বপ্নের পথে । পুরোনো একটি টাইপরাইটার আর বুকের মাঝে বেঁচে থাকা আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে তিনি আবার লেখালেখি শুরু করেন । দিনের পর দিন লেখালেখি চালিয়ে তিনি তাঁর হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম বই “হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্যা ফিলোসফার্স স্টোন” বইটি লেখা শেষ করেন । এবার বইটি প্রকাশ করবার পালা । সেখানে রয়েছে আরেক গল্প। তিনি বইটি প্রকাশের জন্য বিভিন্ন প্রকাশকের কাছে পান্ডুলিপি পাঠাতে থাকেন কিন্তু কেউ তাঁর বইটি প্রকাশ করতে রাজী হন নি । প্রায় ১২ জন প্রকাশক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের ধারণা ছিল এই বই বাজারে চলবে না। শেষ পর্যন্ত ব্লুমসবারি প্রকাশনী তাঁর বইটি ছাপাতে রাজি হয়। প্রথম প্রকাশে বইটির একহাজার কপি ছাপা হয়। যার মধ্যে ৫০০ কপি বই- ই বিক্রি হয় বিভিন্ন স্কুলে , কলেজের লাইব্রেরিতে। বইটি শিশু সাহিত্যের জগতে নিয়ে আসে এক অভিনব বিবর্তন। বইটি প্রকাশের মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই জিতে নিয়েছিল সেরা শিশুসাহিত্যের পুরষ্কার।তারপর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি।এখন বিশ্বজুড়ে তাঁর লেখা বইগুলো বিক্রি হয়েছে চল্লিশ কোটিরও বেশি।পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সফল সবচেয়ে ধনী লেখকের কথা বলতে গেলে এখনও তাঁর নামটি উঠে আসে সবার আগে।

Anything’s possible if you’re got enough nerve.

J.K Rowling

অর্থাৎ আমরা প্রতিদিনের জীবনে নানা কিছু দেখি এবং শিখি।আমাদের মনে হয় এই সব মহৎ ব্যক্তিদের শতবাধা পেরনোর কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি নিজেদের চলার পথকে আরো উদ্যম আরও জেদ নিয়ে লড়াকু মানসিকতা তৈরি করতে পারি তবে আমরাও হয়ে উঠতে পারি আরেকটি হার না মানা গল্পের স্রষ্টা। এরপর থাকবে আরও কয়েকজন বিখ্যাত মানুষের হার না মানার গল্প। সঙ্গে থাক।

Share
PreronaJibon

View Comments