আজ আপনাদের সাধারণ কয়েকটি কথা বলব , যা আমরা হামেশাই আমাদের সন্তানকে বলে ফেলি । আর সেগুলি যখন সন্তানদের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে , তখন আফশোস করি । এর কারণগুলি আমাদের রোজকার কথা, আচরণ থেকেই অর্জন করে সন্তানেরা ।
যে কথাগুলো খুব গভীরভাবে সন্তানদের উপর প্রভাব ফেলে , সেগুলো বলে ফেলার পেছনে থাকে বাবা-মার ধৈর্যহীনতা , অহংকার , ঈর্ষা , অজ্ঞতা ইত্যাদি । অনেকেরই শুনে অভিমান হতে পারে , মনে হতে পারে যে , আমরা এত শিক্ষিত এত জানি । আমাদের সন্তানের প্রতি যা খুশি আচরণ করব । ওরা এমনি ভালো মানুষ হবে । সে হয়ে উঠুক , আমরা সবাই চাই ।
সবাই নিজের সন্তানকে ভালোবাসি আমরা । সন্তানের জন্য পরিশ্রম করি , তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনায় আমরা সর্বদাই চিন্তিত থাকি । আমরা তাদের জন্য প্রচুর অর্থ সম্পত্তির backup গড়ে দেবার জন্য বাড়তি পরিশ্রমও করে থাকি অনেকে । কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা আতঙ্কে থাকি বাস্তবের কিছু উদাহরণ দেখে । বাবা মা সন্তানের জন্য এত করলেও দেখা যায় সন্তান অনেক সময় বিগড়ে যায় । বাবা মার কথা শোনে না । এমন অনেক সন্তান বাবা মার থেকে বিচ্ছিন্ন পর্যন্ত হয়ে যায় । এই সম্পর্ক আদালত পর্যন্ত গড়াতেও দেখা যায় । তখন অনেক বাবা মা-ই আফশোস করেন যে– সন্তান আমাদের মানুষ হল না । যদিও এর পেছনে অনেক কারণ থাকে । তবে একজন সন্তানকে যদি শিশু থেকেই ভালোভাবে তৈরি করা যায় তবেই তো দেশের ও নিজের মঙ্গল ।
তাই মনে রাখতে হবে উজ্জ্বল কেরিয়ার-ই শুধু নয় , সন্তানকে একজন ভালো মানুষ ক’রে গড়ে তোলাও উচিত । এইজন্যই শিশু মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন কিছু কথা যেগুলি শিশু মনে গভীর প্রভাব ফেলে ।
তাহলে আসুন জেনে নিই এমন ৮ টি কথা যেগুলি কখনই সন্তানকে বলা যাবে না :
১. কথা : তুমি পারবে না / তোমার দ্বারা হবে না / তুমি কোনো কাজ ঠিকমত করতে পারো না ।
প্রভাব : আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে যাওয়া ।
—তুমি কিছু পারো না । কালকেও ওদের বাড়িতে গ্লাসে জলটা পর্যন্ত ভরতে গিয়ে ফেলে দিয়েছ । সেদিন রাকাদের বাড়িতেও……. ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এইভাবে না পারার স-প্রমান তালিকা বাড়তে থাকে । আর এভাবেই সন্তানের আত্মবিশ্বাসটুকু নষ্ট হতে হতে তলানিতে এসে ঠেকে ।
বাইরের মানুষ যে যাই বলুক তাদের কথা ততটা প্রভাব ফেলে না , যতটা বাবা-মা বললে প্রভাব ফেলে । তাই এমন কথা কখনোই বলা উচিত নয় যাতে “পারবো না ” এই কথাটা সন্তানের মনে দ্রুত বিশ্বাসে পরিণত হয় । এর ফলে ভবিষ্যতে কোনো ঝুঁকি নেবার মতো মানসিকতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে । তাই কখনোই সন্তানকে বলা যাবে না —–
ক. তুমি পারবে না —আমি করে দিচ্ছি ।
খ. তোমার দ্বারা হবে না ।
গ. তুমি কিচ্ছু পারো না (সঙ্গে আগের না পারার উদাহরণ ) ।
২. কথা : এখন না , পড়ে শুনবো –দেখছো না কাজ করছি , ব্যস্ত । / কতবার বলেছি , ফোনে কথা বলার সময় ডিস্টার্ব করবে না ।
প্রভাব : গুরুত্ব না দেওয়ায় হীনমন্যতা ও ক্ষোভ ।
আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতা আমাদের ক্রমশঃ ব্যস্ত করে তুলছে । আমরা হারাচ্ছি আমাদের খোলামেলা পরিবেশে মেলামেশার সুযোগ । সন্তানরাও হারাচ্ছে তাদের সুন্দর শৈশব কাটানোর সুযোগ । যার ফলে একদিকে আমরা একা হয়ে পড়ছি আর নানা ব্যস্ততার অজুহাতে সন্তানদেরও অলক্ষ্যেই করে তুলছি একা । মনে রাখতে হবে সন্তানেরা একটা কল্পনা মেশানো বাস্তব জগতে বাস করে । তাদের একাকীত্ব ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে বাঁচাতে হবে । কাজ বা ফোন কোনোটাই সন্তানের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় । তার কথাই আগে শুনতে হবে । তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে “কাজটা করে নিই ” বা ” ফোনটা সেরে নিই” । তাই মনে রাখতে হবে জ্ঞানত বা অজ্ঞানত সন্তানকে কখনোই বলবো না —-
ক. দেখছো না ব্যস্ত । সময় নেই । কাজ করছি । পরে দেখবো ।
খ. দেখছো না বড়রা কথা বলছে । বড়দের কথার মাঝে কথা বলতে নেই ।
গ. দেখছো না ফোন করছি । ডিস্টার্ব করো না ।
৩. কথা : তোমার জন্যই এতো খেটে মরছি । কত টাকা খরচ হচ্ছে তোমার পেছনে । তোমার জন্যই আমরা সব কিছু ত্যাগ করছি ।
প্রভাব : খোটা দেওয়ায় বিদ্বেষ জন্মানো ।
আমরাই পৃথিবীটাকে ভালোবেসে সুন্দর করে তুলতে সন্তানকে নিয়ে আসি । আর অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তাদের মানুষ করে তুলছি । কিন্তু সন্তান একটু বড় হতেই দেখা যেতে থাকে তাদের নিজস্বতা । পড়াশুনায় কম আগ্রহ , আমাদের চাপিয়ে দেওয়া গান- বাজনা -আর্ট -সাঁতার -ক্যারাটে -ডান্স ইত্যাদি কাজগুলোর প্রতি অবহেলা করতেও দেখা যায় । তখনই খোটা দিই ওই কথাগুলো বলে ।
এই কথাগুলো মারাত্বক রকম প্রভাব ফেলে সন্তানের মনে । হাসিখুশি সন্তান হয়ে ওঠে হীনমন্যতার শিকার । যা আগে পারতো , করতো —- মানসিক যন্ত্রণায় দিনে দিনে সেগুলির আরো অবনতি হতে থাকে । তাই কখনোই অর্থ খরচের , ত্যাগ করার বা পরিশ্রমের খোটা ভুলেও দেওয়া যাবে না ।
তাই কখনোই সন্তানদের বলবো না —–
ক. তোমার জন্য কারি কারি টাকা খরচ করছি ।
খ. তোমার জন্য আমরা আমাদের সমস্ত শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছি।
গ.তোমার জন্যই আমরা খেটে মরছি ।
৪. কথা : পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসো বলছি ।
প্রভাব : আদেশের বশ্যতায় জেদ বেড়ে যাওয়া ।
মানুষের একটা স্বভাব হলো Bossisom ফলানো । আমি সন্তানের বাবা অথবা মা , আমার কথা শুনবে না এটা মেনে নেওয়া যায় ! আমি টাকা রোজগার করি , সমস্ত খরচ বহন করি আর সন্তান আমারই অবাধ্য হবে ? ভেবে দেখুন এই কথার মধ্যে কতটা অহংকার আছে । সন্তানও তো একই ভাবে বলতে পারে আমি তোমাদের সন্তান আমি যা চাইবো তাই দিতে হবে । না , সেরকম প্রতিযোগিতায় যাওয়া যাবে না । মনে রাখতে হবে সন্তানের কাছে কখনোই রাজার মতো আদেশ করা চলবে না । এই আদেশ মান্য করতে গিয়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয় । ফলে ভেতরে ভেতরে ঘৃণা জমতে থাকে । উদাহরণের অভাব নেই । তাই কড়া শাসনের বা আদেশ দানকারী অভিভাবকত্ব থেকে আজই বেরিয়ে আসুন । যে কথাগুলো বলা যাবে না উদাহরণ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো —–
ক. দু মিনিটের মধ্যে চলে এসো বলছি ।
খ. পাঁচ মিনিটের মধ্যে দেখি যদি এই কাজটা না হয় তবে মারবো ।
গ. আমি বলছি । তোমাকে করতেই হবে ।
৫. কথা : তুমি ভীষণ অবাধ্য । কোনোদিনও কথা শোনো না ।
প্রভাব : পরিচিতির সাধারণীকরণ ।
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় মনে রাখতে হবে ” তুমি ভীষণ অবাধ্য” , ” তুমি ভীষণ দুস্টু ” , ” তুমি কথা শোনো না ” এই কথাগুলির অর্থ হলো সে কখনোই কথা শোনে না বা আজীবন সে দুস্টু । –এই কথাগুলো হলো সাধারণীকরণ ।
কথাগুলো একটু বদল করে বলা যায় , “তুমি না আজ কিন্তু একটু দুস্টুমি করে ফেলেছো ” , ” তুমি একটুখানি অবাধ্যতা করেছো আজ ” ।
আসলে NLP (Neuro Linguistic Program ) তত্ব অনুসারে বলা যায় যে Behaviour এর জন্য Identity কে খারাপ বলা যাবে না । দুস্টুমি করতেই পারে এটা তার Behaviour কিন্তু তার জন্য তার Identity দুস্টু বলতে পারি না । এভাবে তার Identity কে খারাপ বললে তার নিজের বিশ্বাস জন্মে যাবে যে সে আদতেই দুস্টু । তখন আর ভালো হবার চেষ্টাও করবে না । কেন না এটাই তার Identity । তাই শিশু কিশোর মনস্তত্ব অনুসারে বলতেই হয় যে , এই ধরণের কথা সন্তানকে বলা যাবে না —
ক. তুমি ভীষণ অবাধ্য ।
খ. তুমি ভীষণ দুস্টু ।
গ. তুমি কখনোই কথা শোনো না ।
৬. কথা : অমুক কীভাবে পারছে , তুমি কেন পারো না ?
পাশের বাড়ির ছাত্র বা তোমার ফ্রেন্ড তো 100 তে 100 পেলো তুমি কেন পারলে না ? প্রভাব : তুলনা করার ক্ষতিকর প্রভাব ।
আমরা কথায় কথায় কারো না কারো সঙ্গে সন্তানদের তুলনা করে বসি । মনে রাখতে হবে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা – — তাদের দক্ষতা , রুচি , স্বভাব সব । তাই তুলনা করে আমরা শুধু তাদের ব্যক্তিত্বকেই ছোটো করছি না , তারমধ্যে জাগিয়ে দিচ্ছি হীনমন্যতাবোধও । যার ফলে তৈরি হতে থাকে বিদ্বেষ ও ঈর্ষাবোধও । যে কোনো কাজে ব্যর্থ হলেই তুলনা নয় বরং প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে কী কী শিক্ষা পাওয়া যায় তাই বোঝানো ভালো । পরেরবার কীভাবে আরো নিখুঁতভাবে কাজটি করা যায় , তার চেষ্টা করা দরকার । আর এভাবেই সন্তানদের দুঃখ কষ্টের সহচর হওয়া বাবা মায়ের বড় দায়িত্বও বটে ।
৭. কথা : এত খাওয়াচ্ছি , ডাক্তার দেখাচ্ছি তবু চেহারা এমন । /দিন দিন কি বিশ্রী চেহারা বানাচ্ছো । প্রভাব : শরীর নিয়ে সমালোচনার ফলে হীনমন্যতা ।
সন্তানকে সরাসরি কিংবা অন্য অভিভাবক , বন্ধু, আত্মীয় , বা যে কারো সামনেই চেহারা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা যাবে না । মনে রাখা দরকার , নিজের সন্তান কেন কোনো মানুষকেই তার সামনে চেহারা নিয়ে সমালোচনা করা উচিত নয় ।
এর ফলে আপনার সন্তান আপনার সামনে থেকে পালিয়ে বেড়াবে , ঘরকুনো হয়ে উঠবে আর অসামাজিক একটা স্বভাব তৈরি হবে । কারো সঙ্গে মেলামেশা না করলে বাবা মার খুব যন্ত্রনা হয় । ঐদিকে সন্তানও হীনমন্যতার শিকার হয়ে নিজেকে ছোট্ট কারাগারে বন্দি করে ফেলে , যা পরবর্তী বৃহত্তর জীবনে সমস্যা আরো বাড়িয়ে দেয় ।
তাই এই কথাগুলো এড়িয়ে চলতে হবে —-
ক. কী চেহারা হচ্ছে দিন দিন হারগিলা / হাতি একেবারে ।
খ. এত ওষুধ পত্র ফুড গেলানো হচ্ছে কোনো কাজই হয় না ।
গ. দিন দিন খুব খারাপ হচ্ছে চেহারা ।
৮. কথা : আমরা যদি তোমাদের মতো এত সুযোগ পেতাম না …../ তোমরা না চাইতেই সব পাও , এত সুযোগ সুবিধা , কিন্তু আমাদের সময় …..।
প্রভাব : নিজের সঙ্গে তুলনায় ঈর্ষা ও বিদ্বেষ ।
মনে রাখতে হবে কখনোই নিজের যুগের সঙ্গে সন্তানদের তুলনা করতে নেই । কারণ দুটো যুগের অনেক কিছুই আমূল বদলে গেছে । এই তুলনা অবৈজ্ঞানিক । তাছাড়া বাবা মা যদি নিজের শৈশবের সঙ্গে বার বার তুলনা করেন তাহলে সন্তান বিরক্ত হয় । এর থেকে ভেতরে মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি হয় । এভাবেই হীনমন্যতা বাড়তে থাকে আর নিজের প্রতি দোষারোপ করে করে আত্মবিশ্বাসটুকু হারাতে বসে ।
তাই সন্তানকে বলা যাবে না —-
ক. আমাদের সময় এই করতাম আর তোমরা ?
খ . তোমাদের মতো এত সুযোগ পেলে ……
গ. আমরা এত ঘণ্টা পড়তাম এত খাটুনি করতাম , আর তোমরা …..।
এই বাক্যগুলো নমুনা মাত্র । মনে রাখা প্রয়োজন এই বাক্যের নমুনাগুলো এক একটা বিষয়কে তুলে ধরেছে । এই সব কথা সন্তানকে বলা থেকে বিরত হোন , আর হয়ে উঠুন সন্তানের সহমর্মী অভিভাবক-অভিভাবিকা ।
আশা করি বন্ধুরা এই লেখাটি খুব কাজে লাগবে জীবনে ।
আসলে আমরা এরকম অনেক আর্টিকেল পড়ি আর ভুলে যাই । সন্তান মানুষ করা ভীষণ ধৈর্যের কাজ । এত ভালোবাসার সন্তানের জন্য সামান্য কয়েকটি কথা এড়িয়ে চললেই সন্তানের জীবন বদলে যেতে পারে ।
লেখাটি পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ । আমাদের ফেসবুক পেজ এ আসুন আর সঙ্গে থাকুন । আপনার সন্তানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক আরো মধুর হয়ে উঠুক আর আপনার সন্তান আদর্শ একজন মানুষ হয়ে উঠুক –এই কামনা করি ।
আর হ্যাঁ , এই লেখাটি শেয়ার করতে ভুলবেন না , কে জানে আপনার মতোই আর কোনো বাবা -মা উপকৃত হতে পারবেন ।
This Article is Written By
View Comments
অনেক ধন্যবাদ Kishore Majumder ভাই।। এই পোষ্টটি আসলেই আমার চিন্তা ভাবনা বদলে দিল।। ভবিষৎ এ এরকম আরো পোষ্ট পাবো আশা করছি।