শরীর ও স্বাস্থ্য

রাগ কেন হয় , কিভাবেই বা তা কমবে । জানতে হলে দেখে নাও

6 Minute Read

মানুষ বিভিন্ন অনুভূতির মিশ্রণ দিয়ে গড়া । রাগও তেমনি একপ্রকার মানবীয় অনুভূতি। আবেগ অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ খুব কম মানুষেরই থাকে। রাগ ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু কখনো কখনো রাগের বশবর্তী হয়ে মানুষ এমনকিছু কাজ করে ফেলে যা মুহূর্তেই নষ্ট করে দেয় দুটো মানুষের সুন্দর সম্পর্ককে । এর ফলে অনেক সর্বনাশা দুর্ঘটনাও ঘটে যায় । মাত্রাতিরিক্ত রাগ শুধু সুন্দর সম্পর্ককেই নষ্ট করে না এর ফলে নানা শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে । যেমন – ব্লাড প্রেসার , মেন্টাল ডিসওর্ডার , ADHD ইত্যাদি। সুতরাং সবধরনের ক্রোধকে বা রাগকে নিয়ন্ত্রন করা দরকার ।

প্রথমেই জানতে হবে রাগের কারনগুলি কী কী হতে পারে ? তারপর তা কমানোর জন্য উপায় বের করতে হবে আমাদের । রাগ করলে যতটা না অন্যের ক্ষতি করে তারচেয়ে অধিক ক্ষতি হয় আমাদের নিজেদের । রাগের কারনে আমরা শারীরিক ও মানসিক দুই ভাবেই ধ্বংস হতে থাকি । তার প্রভাব পড়ে আমাদের কর্মজীবনে তথা পারিবারিক জীবনে। আমার মতে, রাগ দুটো ফর্মে প্রকট হয়ে থাকে ।

I) ফিজিক্যাল অ্যাঙ্গার ।

II) সাইকোলজিক্যাল অ্যাঙ্গার ।

যদিও রাগকে এইভাবে ভাগ করা হয় নি , বিষয়টি বোঝানোর জন্য আমি এভাবে বিশ্লেষণ করেছি , এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা ।

ফিজিক্যাল অ্যাঙ্গার :-

রাগের বহিঃপ্রকাশের কারন যখন শারীরিক কোনো কষ্ট বা যন্ত্রণার অনুভূতি থেকে হয় তখন তাকে ফিজিক্যাল অ্যাঙ্গার হিসেবে ধরা যেতে পারে । যেমন ধরো , খুব খিদে পেয়েছে তখন হাতের কাছে খাবার না পেয়ে রাগ ওঠে যায় এবং আচরণে তার বহিঃপ্রকাশ পায় , সেটা আসলে ফিজিক্যাল অ্যাঙ্গারের বিষয় । শিশুদের ক্ষেত্রে এই ফিজিক্যাল অ্যাঙ্গার এর লক্ষণ বেশি প্রকাশ পায় । আবার এই ধরনের রাগ তাড়াতাড়ি ওঠে এবং নেমেও যায় । 

সাইকোলজিক্যাল অ্যাঙ্গার :- 

 যা আমাদের মানসিক কারণে হয়ে থাকে । মানসিক অসন্তুষ্টি , দীর্ঘদিনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনবরত কাজ করে চলা , আকাঙ্খার অতৃপ্তি, গ্রহনযোগ্যতা বা মান্যতার অভাবের কারনে আমাদের মধ্যে এইধরনের রাগের প্রবনতা আরও বাড়তে থাকে । এই ধরনের রাগের সাথে বোঝাপড়া করা একটু কঠিন হয়ে যায় আমাদের জীবনে । আর কখনো কখনো এটা মারাত্মক আকার ধারণ করে । সাইকোলজিক্যাল অ্যাঙ্গারের উৎস হিসেবে ধরা যেতে পারে এই নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকে –

ক। ভয়

খ। হতাশা 

গ। অপরাধবোধ 

ঘ। হীনমন্যতা 

ঙ। অহংবোধ

চ। অর্থনৈতিক টানাপোড়েন

ছ। ঈর্ষা

জ। সামাজিক মর্যাদা 

ঝ। মাদকাসক্তি

ঞ। আকাঙ্ক্ষার অতৃপ্তি

ট। মতাদর্শের পার্থক্য ইত্যাদি।

এতক্ষণ জানলাম কী কী কারনে রাগ হতে পারে । এখন জানবো কীভাবে আমরা আমাদের রাগ কমাতে পারি । তাহলে চলো জেনে নেওয়া যাক কয়েকটি উপায় –

১) রাগের উৎস খোঁজো :-

যখন ভীষণ রাগ উঠবে তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজের ভেতরে রাগের সঠিক কারণটি দেখার চেষ্টা কর । কী কারনে আমার রাগ উঠেছে ? এর উৎস ঠিক কী ? রাগ ওঠার কারণটি কি আদৌ তাৎপর্যপূর্ণ , নাকি অহেতুক ? আমরা বেশিরভাগ সময়ই বিনা কারনে রেগে যাই , হয়তো ঘটনা খুবই সামান্য কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠে ভীষণই ভয়ানক । আর ক্রোধান্বিত অবস্থায় আমার যে কাজগুলি করে থাকি তাতে আমাদের নিজের যেমন ক্ষতি হয়ে থাকে তেমনি ক্ষতি হয়ে থাকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের । তাই রাগ উঠলে তোমার ভেতরে রাগের উৎস দেখার চেষ্টা কর এবং ভাবো আদৌ এর জবাব দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা ? এতে রাগ আর রাগ থাকে না , বুদ্ধি এসে তাতে অন্তরায় সৃষ্টি করে । 

২) রাগ নামক শক্তিটি কে সৃজনশীল কাজে রুপান্তরিত করতে পারো :-

রাগ একটি মানসিক অনুভূতি এর যেমন ভয়ানক দিক আছে তেমনি চিন্তা করে দেখলে দেখা যাবে এর ভালো দিকও আছে । ঈশ্বর সবধরনের অনুভূতি দিয়ে মানুষকে গড়েছে । তাই রাগ পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে এটা না ভাবাই ভালো । রাগ একটি শক্তি অন্যান্য অনূভূতিগুলি যেমন ঠিক তেমনি । তাই রাগ বিষয়টিকে খারাপভাবে না দেখে একে কাজে লাগাতে পারো তুমি । রাগ উঠলে সেই শক্তিটি কোনো না কোনোভাবে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায় , হয় কথার মাধ্যমে নয়তো শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে। হয় ভাঙচুর নয়তো কাউকে আঘাত হেনে । তুমি যদি সেই সময় রাগ নামক শক্তিটিকে না দমিয়ে কিংবা অযথা অন্যকোনো খারাপ কাজে না লাগিয়ে সৃজনশীল কোনো কাজে লাগাতে পারো তাহলে ফায়দা টা তোমার হবে, হয়তো তুমি একটা গান লিখলে বা কবিতা লিখলে কিংবা ডায়রিতে লিখে রাখলে সেই ঘটনাটি ইত্যাদি যেকোনো সৃজনশীল কাজ হতে পারে । এতে মনের ভার অনেকটাই কমবে । দেখবে ধীরে ধীরে তোমার অযথা রাগ করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে । তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছো ।

৩) বিষয়টি বুঝিয়ে বলো :- 

আমাদের রাগের নানা কারণ হতে পারে শুরুতেই সেটা বলেছি । রাগের ফলে যখন আমরা সামনের জনের উপর চেঁচামেচি করি তখন সামনের জনের অবস্থাটা কী হতে পারে কখনো ভেবেছ ? তুমি নিজেকেই দিয়ে ভাবো যখন তোমার উপর অযথা কেউ রাগ দেখায় তখন তুমি কি ভাবো ? মনে হয় না ইশ্ একবার তো বিষয়টি বুঝিয়ে বললেই হতো এতে রাগের কি আছে ! ঠিক তেমনি অন্য জনেরও একই ভাবনা আসে যখন তুমি তাদের উপর রাগ দেখাও । তাই রাগ না করে বিষয়টি বুঝিয়ে বলো । দেখ সে কী বলে , হতে পারে তোমার অপছন্দের বিষয়গুলি সামনের জন জানেই না , তাই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করো এতে তোমার রাগ উঠবে না আর সামনের জনও বুঝতে চেষ্টা করবে ।

৪) হেঁটে এসো :-

রাগের ফলে উভয়ের মধ্যে যে বাকযুদ্ধের সূচনা হয় তাতে ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় না । মনে রেখো রাগ একটি ক্ষনিকের অনুভূতি। সময় বিশেষে আসে আবার চলেও যায় । সবসময় কারো রাগ থাকতে পারে না । কিন্তু রাগের মুহূর্তে মানুষ যেসব কাজ করে থাকে সেটার রেশ সারাজীবন থেকে যায় । তাই যদি রাগের মুহূর্তে নিজেকে সামলাতে না পারো স্থানটি কিছুক্ষণের জন্য ত্যাগ করো । একটা ফাঁকা যায়গায় গিয়ে হেঁটে আসতে পার । এতে রাগ বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে না আর তোমার মন একটু শান্ত হবার সুযোগ পাবে । 

৫) সমস্যার সমাধান খোঁজো :- 

রাগকে অস্বীকার করো না , এটাকে খারাপ অনুভূতি ভেবে এর থেকে পালানোরও চেষ্টা করো না । রাগের হাত থেকে যদি জিততে চাও জবরদস্তি করে কখনো রাগকে কমাতে পারবে না বরং এটা আরও বিকৃত রূপ লাভ করবে । হয়তো এতে তাৎক্ষণিক লাভ হবে কিন্তু সমস্যা পুরোপুরি নির্মূল হবে না । রাগ উঠেছে রাগকে গভীর ভাবে দেখার চেষ্টা করো । নিজের ভিতর চলতে থাকা অনুভূতিগুলিকে গভীর ভাবে বোঝার চেষ্টা করো । অন্যের ওপর দোষারোপ করার আগে নিজেকে একটু দেখ ভুল তোমার নয় তো ? যার উপর রাগ উঠেছে তার সাথে শান্ত মাথায় গভীরভাবে আলোচনা করো । ভুল থাকলে স্বীকার করে নাও । রাগান্বিত অবস্থায় কখনো সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবে না , বরং সমস্যা আরও বাড়বে । ঠান্ডা মাথায় সমাধান খোঁজার চেষ্টা করো । দেখবে রাগ নিয়ন্ত্রনে আসবে ।

৬) গভীরভাবে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করো :- 

ভীষণ রাগ উঠেছে তখন গভীরভাবে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করো । ১ থেকে ১০ গুনতে গুনতে শ্বাস নাও আবার ১০ গুনতে গুনতে শ্বাস ছাড়ো । এতে কিছুক্ষণের জন্য তোমার মন অন্যদিকে সরে যাবে । গভীর শ্বাস নিলে শরীর ও মস্তিষ্কে অক্সিজেনের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। শরীরের সমস্ত কোষ অধিক কুশলতা পূর্বক কাজ করবে । রক্তে অক্সিজেনের সঞ্চালন ভালো হবে । এতে তোমার মানসিক সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাবে ফলে তোমার রাগটাও কমে যাবে।

৭) Three seconds rule:- 

মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় একথা প্রমাণিত যে , মানুষের হঠাৎ উঠে যাওয়া রাগের স্থায়ীত্ব কাল ২ সেকেন্ড কিংবা ২.৫ সেকেন্ড। এই ক্লাইমেক্স পিরিয়ডটি পার করতে ব্যবহার করা হয় থ্রি সেকেন্ড রুলস্ । যদি কেউ রাগ উঠলে ওই থ্রি সেকেন্ড অন্যকোনো দিকে মনোনিবেশ করতে পারে তাহলে রাগের প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচা যায় । আবার মনে রেখ, যারা দুই সেকেন্ডের মধ্যে রাগ দেখায় তাদের রাগের প্রকাশ সঙ্গে সঙ্গে রি-জেনারেট হতে থাকে অর্থাৎ রাগ বাড়তেই থাকে । তাই বন্ধুরা তোমাদের রাগ উঠলে তিন সেকেন্ড সময় চোখ বুঝে থাকো , দূরের কিছুর দিকে দৃষ্টি দাও কিংবা যেকোনোভাবে ভাবনান্তর ঘটাও । ব্যাস কেল্লা ফতে ।

৮) এক্সারসাইজ করো :- 

রোজ কুড়ি মিনিট এক্সারসাইজ করে নিজেকে সুস্থ রাখো । এক্সারসাইজ করলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের প্রবাহ যেমন বাড়ে তেমনি রক্তে অক্সিজেনের সঞ্চালনও সঠিক মাত্রায় হয় । এর ফলে শরীরের অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে মুক্তি ঘটে । যার ফলস্বরূপ তাৎক্ষণিক রাগ নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে । 

৯) ক্ষমা করো :-

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে ” to err is human, to forgive divine” যার অর্থ ভুল করা মানব ধর্ম, ক্ষমা করা দেব ধর্ম । আমরা সকলেই কমবেশি ভুল করে থাকি । অন্যেরও ভুল হতে পারে । অন্যের জায়গায় নিজেকে রেখে তুমি প্রশ্ন করো নিজেকে , তোমার কি কখনো ভুল হয় না ? এই সহানুভূতির দৃষ্টিতে সামনের জনকে দেখ , একটু নিরপেক্ষ ভাবে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করো । এই পৃথিবীতে কোনো বিষয় চিরস্থায়ী নয় , তোমার রাগটাও চিরকাল থাকবে না , তবে কেন রাগের বশবর্তী হয়ে সম্পর্কের ইতি টানো ? ক্ষমা করো । ক্ষমাই পরমধর্ম । ক্ষমাই পারে সম্পর্কের গভীরতা বাড়াতে , ক্ষমার মধ্যেই পাবে নির্ভেজাল আনন্দ । এতে তোমার রাগও ধীরে ধীরে কমতে থাকবে । 

১০) কিছু খাবার এড়িয়ে চলো :-

যদিও মানুষের রাগ হওয়াটা অনেকক্ষেত্রে আবেগজনিত ব্যাপার কিন্তু এর সাথে খাবারেরও সম্পর্ক আছে । বেশকিছু খাবার আছে যা নিয়মিত খেলে রাগের সাথে জড়িত হরমোনের নিঃসরণ ঘটে যা হঠাৎ করেই অতিরিক্ত রাগ ওঠার পেছনে কাজ করে থাকে । যেমন – ফাস্টফুড , তেলেভাজা খাবার , অতিরিক্ত চিনির বিকল্প খাবারগুলি না খাওয়াই ভালো । 

১১) কাউন্সেলিং করাও : –

রাগ কোন ব্যাধি নয় । স্বাভাবিক একটি অনূভূতির প্রকাশ মাএ । তবে যদি এমন হয় যে রাগ নিজের নিয়ন্ত্রেণর বাইরে চলে যাচ্ছে দিন দিন , আর সাথে সাথে মানসিক ও শারীরিক অবনতি ঘটছে তাহলে বিষয়টিকে অবহেলা না করে উপযুক্ত মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নাও। দেখবে তাদের সুপরামর্শে তোমার রাগ নিয়ন্ত্রনে থাকবে আর এর কুফল থেকে রেহাই পাবে ।

তো বন্ধুরা, আশা করি এই লেখাটি তোমাদের খুব ভালো লাগবে । খুব ভালো থেকো আর আমাদের ফেসবুক পেজটিকে লাইক করতে ভুলে যেও না যেন ।

This Article Is Written By

Ferdousi Manjira
Founder & Writer

Ferdousi manjira is the founder of preronajibon. She loves to write about life solutions.She writes to express her thoughts so that others will be inspired.

Share
PreronaJibon