লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি – জীবনী, বিখ্যাত চিত্রকর্ম ও উক্তিসমূহ
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ভিঞ্চি(এপ্রিল ১৫, ১৪৫২ – মে ২, ১৫১৯) , পূর্ণ নাম Leonardo di ser Piero da Vinci লেওনার্দো দি সের পিয়েরো দা ভিঞ্চি)। লিওনার্দো ইতালির ফ্লোরেন্সের অদূরে তুসকান অঞ্চলে ভিঞ্চি নামের ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৪৫২ সালে। তার মা ক্যাটেরিনা দ্য মিও লিপ্পি এবং বাবা স্যর পিয়েরো দ্য ভিঞ্চি।ভিঞ্চি উপত্যকায় জন্ম নেয়ার কারণে তার নামের শেষে জুড়ে দেওয়া হলো দ্যা ভিঞ্চি। লিওনার্দো ছিলেন রেনেসাঁ বা ধ্রুপদী যুগের এক বহু গুণান্বিত মেধাবী ব্যক্তিত্ব।তিনি একজন শিল্পীর পাশাপাশি ছিলেন রেনেসাঁ পলিম্যাথ, গণিতবিদ, সংগীতশিল্পী, আর্কিটেক্ট, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং লেখক। এখানেই শেষ নয় ; চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা,অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা,উদ্ভিদবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং সাহিত্যে তাঁর ছিল অসাধারণ দখল। এছাড়াও তাঁর দুই হাতে একসাথে লিখতে পারার মত বিরল প্রতিভা ছিল। তাই অনেক ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত লিওনার্দোকে “ইউনিভার্সাল প্রতিভা” বা “রেনেসাঁ মানব” আখ্যা দিয়েছেন।
ভিঞ্চি কোন রকম আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া গ্রহণ করেননি। তাঁর লেখাপড়ার সবকিছুই ঘরোয়াভাবে। তাঁর ছিল প্রকৃতির প্রতি ভীষণ টান। এজন্য তিনি বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে কাটাতে পছন্দ করতেন। শৈশব সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় নি, বরং কৈশোরে তাঁর ছবি আঁকার প্রতি আকর্ষণ দেখেই তাঁর বাবা
১৪৬৬ সালে লিওনার্দোর বয়স যখন ১৪ তখন তাঁকে আন্দ্রে ডেল ভেরোচ্চিওর (১৪৩৫-১৪৮৮) কাছে শিক্ষানবিশ হিসেবে পাঠানো হয়, এরপর দ্রুতই তার প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। ভেরিচ্চিও একজন অসামান্য শিল্পী ও ভাস্কর হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। বলা হয়ে থাকে লিওনার্দো নাকি ভ্যারিচ্চিও কে তাঁর “ব্যাপ্টিজম অফ ক্রাইস্ট” ছবিটি আঁকার সময় অনেক সাহায্য করেন। সেখানে লিওনার্দো এমন পারদর্শিতা দেখান যে, ভ্যারিচ্চিও নাকি ভেবেই বসেছিলেন তিনি আর কখনো তুলি হাতে নিবেন না!
সারা জীবনে দশটির মতো পেইন্টিং করেছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। ১৪৭২ সালে তিনি চিত্রশিল্পীদের গিল্ডে ভর্তি হন এবং এই সময় থেকেই তার চিত্রকর জীবনের সূচনা হয়। তাঁর বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে মোনালিসা, দ্য লাস্ট সাপার অন্যতম। এছাড়া রয়েছে ‘লরেঞ্জো দ্য মেডিসি’, ‘ভার্জিন অব দ্যা রকস্’, ‘লেডি উইথ অ্যান আরমিন’, ‘সেন্ট জন ব্যাপটিস্ট’,প্রভৃতি।
পৃথিবীর ইতিহাসে এটি সবচেয়ে আলোচিত এবং এটিই রেনেসাঁ যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম। ধারণা করা হয় ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে তিনি এ ছবিটি এঁকেছিলেন। শিল্পকর্মটি ফ্রান্সের ল্যুভ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ল্যুভ জাদুঘরের তথ্যমতে প্রায় ৮০% পর্যটক শুধু মোনালিসার চিত্র টি দেখার জন্য আসে। ছবিটি আঁকতে তার প্রায় চারবছর সময় লাগে। মোনালিসার এই ছবিটির মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রায় ৮৩০ মিলিয়ন ডলার। যা প্রায় ৫ হাজার ৭১২ কোটি টাকার সমান। অনেক শিল্প গবেষক পোর্ট্রেটের এই বিখ্যাত নারীকে ফ্লোরেন্টাইনের বণিক ফ্রান্সিসকো দ্য গিওকন্ডোর (Gioconda) স্ত্রী লিসা গেরাদিনি বলে সনাক্ত করেছেন। আবার অনেকে প্রায় লোমহীন মুখটায় অনেকে দাড়ি লাগিয়ে স্বয়ং লিওনার্দোকেই আবিষ্কার করে ফেলেন, অর্থাৎ তারা দাবি করেন, মোনা লিসা চরিত্রটি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নারীসত্ত্বা (এক্ষেত্রে ড্যান ব্রাউন এর দ্য ভিঞ্চি কোড বইটিতেও কিছুটা বলা হয়েছে)
আরও পড়ুন : এ. পি. জে. আব্দুল কালামের বিখ্যাত উক্তি ও বাণীসমূহ
মোনালিসার পর এই ছবিটিকেই লিওনার্দোর সেরা কীর্তি হিসেবে মনে করা হয়। ধারণা করা হয় ১৪৯৫-১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ছবিটি আঁকা হয়েছিলো। ছবিটিতে মাঝখানে উপবিস্ট যীশুখ্রীষ্টকে তাঁর চারপাশে শিষ্যদের নিয়ে শেষ নৈশভোজরত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।
এটি লিওনার্দোর একটি বিখ্যাত ফ্রেস্কো অর্থাৎ দেয়াল চিত্রকর্ম। এর অবস্থান ইতালীর মিলান শহরের সান্তা মারিয়া ডেলা গ্রেইজি চার্চের ডায়নিং হলের পেছনের দেয়ালে। ছবিটি বিখ্যাত হয়ে আছে এর পেছনের গল্পের জন্য। যদিও যীশু খ্রিষ্টের লাস্ট সাপার বিষয়ে আরও অনেক চিত্র আছে, তবু চিত্রশিল্পবোদ্ধাদের দুনিয়ায় এই ছবিটিই সবচেয়ে বিখ্যাত এবং আলোচিত। ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই, খ্রিস্টান ধর্মমতে, যীশু শেষবারের মতো বসেছেন তার শিষ্যদের নিয়ে নৈশভোজে। খাওয়ার পর তিনি তার শিষ্যদের বলেন, পরদিন তোমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। যীশুর সে ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর তার শিষ্যরা নিজেদের মধ্যে “কে সেই বিশ্বাসঘাতক?” এই বিষয়ে আলোচনা করছে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এ ছবিতে যিশুর মুখ ফুটিয়ে তোলার জন্য দীর্ঘ সময় নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়, যাতে যিশুর মুখে অভিব্যক্তিহীন একটা আবহ ফুটিয়ে তোলা যায়।
বিজ্ঞান এবং কলার সংমিশ্রনে ১৪৯০ সালে আঁকা “ভিট্রুভিয়ান ম্যান” স্কেচ। ছবিটি তিনি জনসাধারণের জন্য আঁকেননি, এঁকেছিলেন মানবদেহ এবং গনিতের প্রতি নিজের অদম্য কৌতূহল থেকে। বর্গক্ষেত্র এবং একটি বৃত্ত উভয় এর ভিতরে একটি পুরুষ চিত্র যার হাত পা বিভিন্ন দিকে আলাদা ভাবে ছড়ানো, সুপারিম্পোসড(উপরে স্থাপিত করা-place one over another) অবস্থায় চিত্রিত রয়েছে যা “ভিট্রুভিয়ান ম্যান” নামে পরিচিত। ছবিটিতে বেশ কিছু অনুপাতও লিপিবদ্ধ করা ছিলো। আর এই অনুপাতগুলোকেই বলা হয় ‘মানবদেহের ঐশ্বরিক অনুপাত’ বা Divine Proportion। বর্তমানে এটি ইতালির ভেনিস শহরের আকাদেমিয়া নামক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
এটি ১৪৮৯–১৪৯০ সময়কালের মাঝে আঁকা একটি তৈলচিত্র। ছবিটির বিষয় ছিল একজন নারী যাকে সিসিলিয়া গালেরানি (Cecilia Gallerani) বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি ছিলেন মিলানের ডিউক লুডোভিকো স্ফরযার (Ludovico Sforza) প্রিয় পত্নী। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এই সময় ডিউকের হয়েই কাজ করতেন। এটি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মাত্র চারটি নারী প্রতিকৃতির একটি। বর্তমানে এটি পোল্যান্ডের চারতরস্কি মিউজিয়ামে (Czartoryski Museum) প্রদর্শিত হচ্ছে।
১৫০৮ সালে আঁকা এই ছবিতে ভার্জিন মেরি, প্রভু যীশু এবং জন দ্য ব্যাপ্টিস্টকে দেখানো হয়েছে। তৈলচিত্রে এই ছবিটি ছয় ফুটেরও বেশি উঁচু। ভার্জিন অন দ্য রক্সের মধ্যে আরেকটি ছবিকে খুঁজে বের করা হয়েছে, কিন্তু ছবির ভিতরে ছবি কেন রয়েছে, সেই রহস্যটা কিন্তু রহস্যই থেকে যাবে। এই ছবিটিকে অনেক সময় Madonna of the Rocks-ও বলা হয়। ছবিটির দুটি সংস্করণ আছে। মূল ছবিটি আছে প্যারিসের লুভর যাদুঘরে। এই কারণে একে বলা হয় লুভর সংস্করণ। ছবিটির লন্ডন সংস্করণ রয়েছে লণ্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে।
প্রযুক্তিবিদ ভিঞ্চি নিজে থেকে অঙ্কন করেন ফিল্ড ব্রিজ,অ্যানিমোমিটার, ডুবোজাহাজ,প্যারাসুট, গ্লইডার,স্কুবাগিয়ার, হেলিকপ্টারের নকশা, ফ্লায়িং মেশিন, কামান, বিভিন্ন রকম বিরাটাকার যুদ্ধযান ও যুদ্ধাস্ত্র। এ ছাড়াও সহজে বহন ও স্থাপনযোগ্য সেতু, ডুবোজাহাজ, ক্যালকুলেটর, এমনকি রোবট গড়বারও পরিকল্পনা করেন তিনি।
জানা যায় লিওনার্দো সে সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ ছিলেন। ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঘোড়ার মাথার আকৃতির একটি বীণা তৈরি করে বিরল প্রতিভার পরিচয় দেন । পরে Lorenzo de’ Medici লিওনার্দো-র এই বীণা উপহার স্বরূপ মিলানের ডিউক Ludovico il Moro – র কাছে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধের না করার শান্তিচুক্তি নিশ্চিত করার জন্য।
২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি মার্কিন চলচ্চিত্র-দ্য দা ভিঞ্চি কোড (ইংরেজি ভাষায়: The Da Vinci Code) । দ্য দা ভিঞ্চি কোড উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন রন হাওয়ার্ড । দ্য ডা ভিঞ্চি কোড বইয়ের কাহিনিতে ড্যান ব্রাউন লিখেছেন, মোনালিসা নামটি আসলে মিসরীয় দেবী আমন এলইসার নাম থেকে এসেছে । ড্যান ব্রাউনের এ উপন্যাসটি ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল । ভিনসেতি বলেন, ‘লেওনার্দো প্রতীক ও সংকেতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।
ভিঞ্চি তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ১৫১৩ থেকে ১৫১৬ পর্যন্ত সময় তিনি রোমের দশম পোপ এর অধীনেই কাটান বলে জানা যায়। ১৫১৫ তে রাজা ফ্রান্সিস ১ম মিলান দখল করলে তিনি তখন রাজার বাসভবনের পাশেই “ক্লস লুইস” নামক আবাসে বাস করতে শুরু করেন। এখানেই তিনি তার জীবনের পরবর্তী ৩ বছর অতিবাহিত করেন।
এই বিস্ময়কর মানবিক প্রতিভা লিওনার্দো এই “ক্লস লুইস” ভবনে ২রা মে ১৫১৯ পরলোক গমণ করেন।
এই মহান প্রতিভা পুরো মানব জাতির ইতিহাসে খুবই বিরল । তাই তাঁর বিভিন্ন সময়ে বলা ও লেখা উক্তিগুলি নিশ্চই খুব তাৎপর্যপূর্ণ হবে সে বিষয়ে সংশয় নেই । তাহলে এসো বন্ধুরা , আজ আমরা জেনে নিই , লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত কিছু উক্তি ।
১.” সরলতাই হলো চূড়ান্ত জটিলতা।“
২. ” শিল্প কখন ও শেষ হয় না, শুধুমাত্র পরিত্যক্ত হয়।”
৩. “ প্রথম পরিচয়ে কোন কিছুই পছন্দনীয় বা ঘৃণিত হতে পারে নাহ। ”
৪. ” অশ্রু কখনই মস্তিষ্ক থেকে আসে না, বরং তা আসে হৃদয় থেকে ’
৫. “উত্তম আনন্দ হচ্ছে কোন কিছু বোঝার আনন্দ।”
৬. “জল সমস্ত প্রকৃতির চালিকা শক্তি।“
৭. ” আমি ঈশ্বর ও মানবতাকে আঘাত করেছি৷ কেননা আমার কাজ যতটা ভালো হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি৷“
৮. “উত্তম আনন্দ হচ্ছে কোন কিছু বোঝার আনন্দ।”
৯. ” শেখা মনকে কখনো ক্লান্ত করে না। “
আশা করি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নিয়ে আমাদের লেখাটি আপনাদের ভালো লাগবে। ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটিতে যুক্ত থাকো।