শিক্ষা ও জীবন

রেজাল্ট নিয়ে হতাশা : এসো জেনে নিই করণীয় ১০ টি বিষয়

6 Minute Read

তোমার বন্ধু অরুণাভ কত নম্বর পেয়েছে ? আর তুমি ?একই সঙ্গে তো পড়ছো । ওর ঘাড়ে কি দুটো মাথা ? এই রেজাল্ট নিয়ে কী করবে তুমি ? না সাইন্স নিতে পারবে , না ভালো কোনো সাবজেক্ট নিতে পারবে , না ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার কিছুই তো হতে পারবে না । তোমার জন্য মুখ দেখাতে পারবো না ।

এরপর আর বলার দরকার নেই । ভীষণভাবে মন ভেঙে দেওয়া হল সন্তানের ছাত্র বা ছাত্রীটির । তার আর কোনো জায়গাই রইলো না যাবার ।
কিন্তু আমরা যদি একটু আধুনিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি , তাহলে দেখা যাবে কতগুলি বিষয় যা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে ।

মনে রাখতে হবে সকলেই সমান নয় ; প্রত্যকের দক্ষতার ধরণ , অভিরুচি , পারঙ্গমতা আলাদা হতে বাধ্য । আর এটাই নিয়ম । সমান করতে চাওয়ার এই চেষ্টাই বৃথা । হাতের পাঁচটি আঙ্গুল যদি টেনেটুনে সমান করার চেষ্টা করা যায় সেটা ব্যর্থ হতে বাধ্য । তার বদলে যদি প্রতিটি অসমান আঙুলের গুরুত্ব বুঝি , তাহলে দেখবো প্রতিটি ছোটবড় আঙুলের আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে ।

যদি সন্তানের আশানুরূপ রেজাল্ট না হয় , অভিভাবক অভিভাবিকা হিসেবে সমব্যথী হয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে । মনে রাখা প্রয়োজন অতীতকে আমরা বদলাতে পারি না , যা বদলানো যায় তা হলো ভবিষ্যৎ । তাই পাশ বা ফেল কিংবা চাহিদা অনুরূপ রেজাল্ট না হলেই জীবন শেষ হয়ে যায় না । জীবন একটা দীর্ঘ জার্নি , তাই হতাশ না হয়ে অতীতকে দায়ী না করে , রেজাল্ট খারাপের হতাশা থেকে মুক্তি পেতে ও ছাত্র বা ছাত্রীটির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে আমরা কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারি । এখানে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক সকলের জন্য কয়েকটি বিষয় তুলে আনা হলো ।
রেজাল্ট খারাপের হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে যে বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে সেগুলি হলো :

১. Marks–ই সব নয় , নম্বরই শেষ কথা বলে না , অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে :

ইংরেজ প্রবর্তীত শিক্ষা ব্যবস্থায় যখন একটা সময় ছিল চাকরি পদের চেয়ে চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হতে শুরু হল , তখন কাজ চালানোর জন্য নম্বরের ভিত্তিতে নিয়োগ শুরু হয় । সেটা কিছুদিন আগে পর্যন্ত চলে আসছিল । আধুনিক ডিজিটাল যুগ সেখান থেকে অনেকটাই সরে এলেও অভিভাবকদের মানসিকতায় রয়েই গেছে এখনো । বর্তমানে কিন্তু যে কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য দক্ষতারই মূল্যায়ন করা হয় ।

একটা মানুষের শিক্ষার পরিমাপ শুধু নম্বরই শেষ কথা হতে পারে না । হয়তো টোটাল নম্বর বা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে কম নম্বর পেয়েছে , কিন্তু তাই বলে তার জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল — তা কখনোই হতে পারে না । আজকের যুগে এই নম্বরের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে সরে এসে দক্ষতা বাড়ানোর দিকেই ফোকাস করতে হবে ।

২. দক্ষতা তৈরির ( skill development ) দিকে নজর দিতে হবে :

আজকের যুগে প্রযুক্তির প্রাধান্য বেশি । তাই যে কোনো চাকরি বা কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় skill বা দক্ষতাকে । কে কোন ইউনিভার্সিটি থেকে বা কোন কলেজ থেকে পাস করলো , কত নম্বর পেলো সেগুলি ক্রমশঃ গুরুত্ব হারাচ্ছে । তাই মনে রাখতে হবে প্রথম থেকেই শিক্ষার্থীকে নম্বর সর্বস্ব নয় , একজন দক্ষ যোদ্ধা তৈরি করতে হবে , যাতে সে জীবনযুদ্ধে সমস্ত বাধাকে অনায়াসে জয় করতে পারে । দক্ষতা বলতে বোঝায় কোনো কাজ ভালোভাবে করার ক্ষমতা অর্জন ও বাস্তবিক ক্ষেত্রে তাকে সুন্দরভাবে প্রয়োগ করতে পারাকে ।
তাই বিভিন্ন কোম্পানিগুলো সর্বদাই সেইরকম কর্মীকে চায় , যে তাদের পক্ষে লাভজনক । ভালো নম্বর পাওয়া ভালো ছাত্রের বিজ্ঞাপন তাদের উদ্দেশ্য নয় । মনে রাখতে হবে একজন ভালো নম্বর প্রাপক যদি দক্ষ না হয় , তাহলে তার চেয়ে খারাপ রেজাল্ট পাওয়া দক্ষ কর্মীরই জয় হবে সর্বত্র । এই উদাহরণ আজ চারদিকেই । তাই আশানুরূপ রেজাল্ট না হলে হতাশা নয় , আগামী দিনে দক্ষ কর্মী করে গড়ে তোলার দিকেই নজর দেওয়া প্রয়োজন ।

৩. অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা :

পৃথিবীর সবচেয়ে সফল ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি বার ব্যর্থ হয়েছিলেন । জীবনে যে কোনো ব্যক্তিই হন না কেন , যদি সফল হয়ে থাকেন , দেখা যাবে তার পেছনে রয়েছে ব্যর্থতার ইতিহাস । তারা সফল এই জন্যই যে , তারা ব্যর্থতাকে ব্যর্থতা বলেন না — বলেন শিক্ষা । আসলেই ব্যর্থতা বলে কিছু হয় না । যাকে আমরা ব্যর্থতা বলি তা আসলে আমাদের জীবনের শিক্ষার এক একটা পাঠ মাত্র ।

একটা সময় মানুষের শিক্ষার পরিমাপ করতেই চালু করা হয় এই পরীক্ষা ব্যবস্থা । কিন্তু কালক্রমে দেখা যায় পরীক্ষা কেবল জ্ঞানগত পরিমাপকেই বেশি গুরুত্ব দেয় এবং আর এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার সম্মুখীন করে তোলে । তাই রেজাল্ট নিয়ে অসন্তুষ্টি থাকলে তার থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনে চলার পথে সেই শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে । আর হ্যাঁ , তবে দেখতে হবে এবং খুঁজে বের করতে হবে নিজের দুর্বলতার দিকগুলিকে । সেগুলি চিহ্নিত করে নিয়ে সামনের দিনে সংশোধন করে জীবনের সাফল্য অর্জন করার দিকে এগিয়ে যেতে হবে । অভিভাবকদেরও এই ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে ।

৪. আত্ম বিশ্বাস বৃদ্ধি :

আত্ম বিশ্বাস ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বন্ধু নেই । আত্মবিশ্বাসই ভবিষ্যতের উন্নতির প্রথম সোপান ।

স্বামী বিবেকানন্দ

এ কথা সত্যি যে পৃথিবীর সমস্ত সফলতার মূল সূত্রধারই হল মানুষের আত্মবিশ্বাস । এই আত্মবিশ্বাস অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে । বার বার ব্যর্থ মানুষ সফল হয়ে তাক লাগিয়ে দিতে পারে । তাই পরীক্ষার ফলাফল মনঃপূত না হলে কখনোই শিক্ষার্থীকে বকাঝকা করে তার আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দেওয়া উচিত নয় । কেন না আপাতভাবে যে সন্তোষজনক ফল করতে পারে নি , কে বলতে পারে একদিন সে-ই হয়তো চোখ ধাঁধানো সাফল্যে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে । তাই ছাত্র-ছাত্রী বা সন্তান যদি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না করতে পারে , তবে তার পাশে থেকে মনোবল বাড়িয়ে দেওয়া উচিত তার পরবর্তী প্রস্তুতির জন্য । ভেবে দেখলে খারাপ লাগবে তাদের জন্য , যারা Form Fillup টাও করতে পারে নি । অনেকে আবার নানা কারণে পরীক্ষা ভালো দিতে না পেরে ফেল করেছে । বা অনেকে কাজের সূত্রে বিদেশে থাকায় পরীক্ষার স্বপ্নটাই অধরা থেকে গেল —- তাদের তাহলে কী অবস্থা ।

৫. যুগোপযোগী বিষয় শিক্ষা :

-Result খুব ভালো ? তুমি কি হতে চাও বড় হয়ে ? ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার ?
উত্তর এলো –
-আমি Web Developer হতে চাই । প্রশ্নকর্তা আকাশ থেকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন ,
-সেটা আবার কী জিনিস ?
প্রশ্নকর্তার জগৎ অনেকটাই সেকেলে । কাজেই শিক্ষার্থীকে মনে রাখতে হবে যে , এই যুগে কেবল মার্কসের বিষয়টি সাময়িক কিছুদিনের জন্য লোকের মনে থাকে । পরে সবাই ভুলে যায় । নিজের জীবনের পথ নিজেকেই করে নিতে হয় । তাই দক্ষতার সঙ্গে এমন বিষয়গুলি পড়ার বা শেখার চেষ্টা করো , যা আগামী দিনে ব্যাপক হারে প্রয়োজন । ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতেই পারো , কিন্তু তার সঙ্গে অনেক অনেক আধুনিক আরো কিছু বিষয় আজকাল আসছে , যেগুলির কথাও ভাবতে পারো । যেমন Web Designing , Graphics Designing , Animation, Camera Technology , Cyber Cecurity , Video-Audio সহ অনেক অনেক আধুনিক ও ডিজিটাল বিজনেসের বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো । এইসব ক্ষেত্রে কিন্তু মার্কস নয় দক্ষতাই বড়ো কথা । আর আগামী মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারলে উন্নতির শিখরে পৌঁছতে আর কতক্ষন তবে দূরদর্শিতা থাকা প্রয়োজন ।

৬. আগ্রহের বিষয় অনুসন্ধান করা :

সকলেরই কম বেশি আগ্রহের বিষয় থাকে । শিক্ষার্থীর রেজাল্টের পর যে ভুলটা অনেকেই করে থাকি , বিষয়ের গুরুত্ব অনুসারে পড়াতে চাই । কোন বিষয়ে চান্স পাওয়া যায় , আগ্রহ থাক বা না থাক ” ভালো সাবজেক্ট ” ব’লে তার পেছনে ছোটা শুরু হয় । এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষার্থীর ভালোলাগা বিষয়কেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত । কারণটা একটাই , যুগের চাহিদা বা ট্রেন্ড এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে শিক্ষার্থীর দক্ষতা । সেক্ষেত্রে আগ্রহ না থাকলে দক্ষতাই গড়ে উঠবে না ।

৭. তুলনা বর্জন করা এবং ‘তুমি তোমার মতো ‘ এই বোধ তৈরি করা :

পরীক্ষার রেজাল্ট সন্তোষজনক না হলে কখনোই ছাত্র-ছাত্রীকে দোষারোপ করা উচিত নয় । আর মনে রাখতে হবে অন্যের সঙ্গে কখনোই তুলনা করা উচিত নয় । এতে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয় । তাকে অভিভাবক হিসেবে বলা ভালো ”তুমি তোমার মতো । আর রেজাল্ট দিয়ে তোমার পরিমাপ হয় না ।” আর এটাও বোঝাতে হবে যে , যে যাই করুক না কেন তোমার জীবনের পথ তোমাকেই বেছে নিতে হবে । তাই তুলনা বন্ধ করে শিক্ষার্থীর নিজস্ব প্রতিভাটিকেই কাজে লাগাতে উৎসাহিত করতে হবে ।

৮. একজন ভালো মানুষ হবার প্রেরণা :

দেশ কী চায় ? দেশ সবার আগে চায় একজন ভালো মানুষ । এই ভালো কথাটির ব্যাখ্যা হাজার রকম হলেও আপাতভাবে বলা যায় , মানবিক গুনে ভরা , সমাজের মানুষের পক্ষে কল্যাণকর একজন মানুষ । হোক না সে সাধারণ ; সে যেন জনসংখ্যা না হয়ে জনসম্পদ হয় । এই জনসম্পদ করেই গড়ে তুলতে হবে আমাদের শিক্ষার্থীদের । তাই নম্বরের অসুস্থ প্রতিযোগিতা নয় , একজন ভালো , সৎ মানুষ করে গড়ে উঠলেই দেশের ও নিজের মঙ্গল ।

৯. দোষারোপ নয় , যতটুকু লড়াই করেছে তার জন্য সাবাসি দেওয়া :

সন্তানের রেজাল্ট খারাপ হলে কখনোই দোষারোপ নয় বরং যতটুকু লড়াই করেছে তার জন্য সাবাসি দেওয়া উচিত । মানুষ নিজের কৃতকর্মের প্রশংসা পেলে আরো উৎসাহী হয়ে কাজ করে । তাই দোষ দিয়ে আর বারবার ত্রুটিগুলো বলে বলে সন্তানের মাথা খাওয়া উচিত নয় । বোঝাতে হবে যে , যতটাই রেজাল্ট করেছে তা নিজের পরিশ্রমেরই ফসল । পরবর্তী পদক্ষেপে যেন আরো ভালো হয় — তার জন্যই চেষ্টা করে যেতে হবে ।

১০. সব সময় পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি :

রেজাল্ট মনঃপূত না হলে শিক্ষার্থী কিন্তু নিজেই হীনমন্যতার শিকার হয় । সেখানে যদি বাবা মা তার জন্য আরো বেশি বেশি বকাঝকা করেন , তবে তার কী হাল হতে পারে ভেবে দেখার বিষয় । হতাশার চরমে পৌঁছতে পৌঁছতে এমনকি ……….. থাক আর নাই বা বললাম । তবে রেজাল্ট যেমনই হোক না কেন অভিভাবকের উচিত সন্তানের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া । কারণ ওরা নিজের খারাপ রেজাল্ট থেকে পরবর্তী জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অভিভাকবকদের সমর্থন চায় । সেটা না পেলে ভেঙে পড়তে পারে । ভালো করার বদলে উল্টে খারাপই হতে পারে ।

তাহলে আশা রাখছি এই লেখাটি আমাদের জীবনে কাজে লাগবে । আর লেখাটি শেয়ার করো সেইসব মানুষদের যাদের বাড়িতে শিক্ষার্থী বা ছাত্র-ছাত্রী আছে এবং সন্তানদের যারা পড়াশুনা করছে । সকলের জীবনে প্রেরণা জাগাতে প্রেরণাজীবন বদ্ধ পরিকর । আরো প্রেরণাময় ও শিক্ষামূলক বিষয়ের আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ এ এসো , সঙ্গে থাকো। খুব ভালো থাকবে , সুস্থ থাকবে ।

This Article Is Written By

Kishore Majumder
Editor & Writer

Kishore Majumder is the editor and writer of preronajibon. He is a teacher, poet and songwriter of bengali culture. He is also well-known as a youtuber and reciter of bengali poetry . He likes to inspire others to live a better life.

Share
PreronaJibon

Published by
PreronaJibon