ভোর পাঁচটায় রাস্তায় বেরিয়ে দেখা হয় একটি ছেলের। ছেলে না বলে ছাত্র বলাই ভালো । ভোরে দেখা হতো বলে বন্ধুত্বের একটা সুযোগ ছিলই ।তাই ক্রমে আলাপ জমালাম। আলাপসূত্রে তার সাধারণ পরিচয় জানার পাশাপাশি একটি বিষয় আমকে খুব ভাবিয়েছে তা হলো ওর হতাশা। একজন ছাত্রের জীবনে একমাত্র তপস্যা বলতে আমরা বুঝতাম অধ্যয়নকে বা সোজা সাপ্টা ভাষায় বলা যায় পড়াশুনাই একটি ছাত্র বা ছাত্রীর প্রধান কাজ। কিন্তু বর্তমান যুগে মানুষ তার জীবনের প্রতিভার অভিমুখ অনুসারে বিষয়গুলিকে প্রধান -অপ্রধান ধরে নেয়। যেমন একজন ছাত্র যার খুব ভালো দক্ষতা আছে গানে এবং তারও স্বপ্ন গায়ক হবার ; তাই সচেতন বাবা মা তার গানের চর্চাকে প্রধান তপস্যা ধরে পড়াশুনা নিয়মিত চর্চার একটি বিষয় হিসেবে রেখেছেন । কোনো ব্যাপার নেই তাতে । কিন্তু আমার ঐ ভোরবেলার বন্ধুটার কথা প্রসঙ্গে একথা কেন বললাম। কারনটি হলো ওর সেরকম কোনো hobby নেই।পড়াশুনাই একমাত্র কাজ । কিন্তু সমস্যাটি হলো সে ভালো পড়া পারে না। Result ও ভালো করতে পারে না। ক্লাসেও শিক্ষক ও ছাত্রদের অবহেলার শিকার ।বাবা মা তাকে উঠতে বসতে কথা শোনায় পড়া না পারার জন্য ।
আমি ঐ বন্ধুটির সঙ্গে মিশে জানতে পারলাম তার হতাশার বিষয়টি। আমার মতে তার হতাশার মূল যে লক্ষণ আর কারণ বলে মনে হল সেগুলি তুলে ধরলাম।
হতাশার বহিঃপ্রকাশ :-
কয়েকটি বিষয় যেগুলি ওর মনে বাঘের থাবার মতো আঁচড় কেটে রেখেছে । ফলে ও পালানোর পথ খুঁজছে বাবা মা , বিদ্যালয়, বন্ধু , আত্মীয় স্বজন এমনকি জীবন থেকেও । তার সঙ্গে কথা বলে যে যে বিষয়গুলি ওর সমস্যার প্রধান বিষয় সেগুলি উদ্ধার করে দেখা গেল মোটামুটি এইরকম —-
i) স্কুলে যেতে ভালো লাগে না ।
ii) বাবা-মা প্রতিনিয়ত পড়ার চাপ দেয় যা অসহ্য ।
iii) নিজের সমস্যা ও মনের অবস্থা বলার মতো বন্ধুর অভাব ।
iv) আত্মীয়দের বাড়ি বা কোনো অনুষ্ঠানে সমবেত পরিচিত জনদের মাঝখানে ভালো ভালো result এর ছাত্রের তুলনায় অস্বস্তি লাগে ।
v) প্রতিবেশিদের কাছে নাকি বাবা মা মাথা নীচু করে থাকে তারই জন্য —-এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর ।
Vi) school এ শিক্ষকদের কাছে বারংবার অপমানিত হতে হয় ।
vii) সহপাঠীরদের কাছেও একই অবস্থা হয় ।
viii) সর্বোপরি নিজের খুব ইচ্ছা ভালো পড়া করবে । কিন্তু কিছুতেই মূল সমস্যা বুঝে নিতে পারছে না ।
ix) পড়তে বসে সমস্ত ভাবনা চিন্তাগুলিই পড়তে দেয় না, জ্বালাতন করে ।
x) নিজের জীবনের প্রতি ঘৃণা জন্মায় , পালানোর মানসিকতা । সবার আড়ালে থাকার বাসনা আরো কোণঠাসা করে তোলে তাকে ।
আর ভাবতে গিয়ে যা বোঝা গেল, সে হিসেবে দেখা যায়
হতাশার যেসব মূল কারণ:-
এইসব হতাশার প্রতিফলন মাত্র । আমরা যদি এর মূল কারনগুলি খুঁজে দেখি তাহলে দেখবো কিছু জীবনের সত্য উঠে এসেছে । বিষয়টিকে আমরা যদি বিশ্লেষণ করতে যাই তবে দেখা যাবে তার হতাশার কারণগুলো।
খুব সংক্ষেপে ছাত্র বন্ধুটির হতাশার কারনগুলি হলো :
i) পূর্বের পড়ার gap গুলি জমে ওঠেছে ।
ii) পিতা-মাতার অত্যধিক চাপ এবং শাসনের ভয় ছাত্রটিকে সমস্যা আড়াল করতে শিখিয়েছে ।
iii) উপযুক্ত খোলামেলা পরিবেশের অভাব যা ছাত্রটিকে সাময়িক বিষয় নির্ভর করে তুলেছে – নিজের ও ভবিষ্যতের ভালোটা বোঝার সুযোগ দেয় নি ।
iv) ভালো শিক্ষক শিক্ষিকার সুনজর থেকে বঞ্চিত হয়েছে ; ফলে কোনো সমস্যা ও না পড়া বিষয়গুলির বোঝা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বাইরে স্থাপন করেছে তাকে ।
v) বাবা মা আত্মীয় স্বজন সকলের কথায় কথায় তুলনার অভ্যাস তাকে কোনঠাসা করেছে এমনকি মানসিক যন্ত্রণার জন্মদিয়েছে যা — পড়তে মন বসায় বাধার সৃষ্টি করেছে ।
vi ) খুব সহানুভূতিপূর্ণ আচরণের অভাব। পারা বিষয়গুলির উপযুক্ত প্রশংসা ও হাতধরে শেখানোর লোক এবং আগ্রহী করে তোলার মতো উপাদানের অভাব রয়েছে ।
vii) হতাশা দূর করার মতো পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণের অভাব। এতে বাবা-মা, শিক্ষক, সহপাঠী বন্ধু সকলের ভূমিকা আছে ।
যদিও বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনার দাবী রাখে। তবুও যদি খু-উ-ব কম কথায় বলা যায় তবে এইভাবে বলতে পরি ।
পড়া না পারা হতাশা ছাত্রের জন্য তিনটা ক্ষেত্রে মূল সমাধান রয়েছে। । এই তিনটি ক্ষেত্র হল – অভিভাবক বা বাবা-মা, শিক্ষক বা শিক্ষিকা এবং সহপাঠী কোনো বন্ধু ।
প্রধান তিনটি করণীয় :
১। অভিভাবক ( বাবা মা) কী করে হতাশা দূর করতে পারে :-
একজন শিশু বড় হতে থাকে অভিভাবকের তত্বাবধানে। কাজেই বাবা মা বা অভিভাবকের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। সন্তানের হতাশা দূর করতে তাকে সবার আগে যে বিষয়গুলির উপর নজর দিতে হবে :
i) বন্ধুর মত মন খুলে কথা বলতে হবে।
ii) সন্তানের পড়া না পারার বিষয়টি মন দিয়ে শুনতে হবে এবং আশু সমাধানের ভাবনা যৌথ ভাবে ভাবতে হবে।
iii) সন্তানকে কখনই বকা বা অবজ্ঞা করা যাবে না।
iv)যতটা সম্ভব সাহায্য করা যেমন , পড়া বোঝানো , কারো সাহায্য নিতে বলা ইত্যাদি করতে হবে।
v)প্রয়োজনে বিদ্যালয় শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি খুলে বলে পরামর্শ নিতে হবে।
Vi) অবশ্যই অন্যের সঙ্গে তুলনা বন্ধ করতে হবে।
২। শিক্ষক-শিক্ষিকা-সহপাঠী কী করতে পারে :-
বাবা মার পরই শিক্ষার্থী শিক্ষককে স্থান দেয়। তাই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উচিত অন্যের সঙ্গে তুলনা বন্ধ করা । সেই সঙ্গে ছাত্র বা ছাত্রীটি যে বিষয়ে ভালো পারে , তার প্রশংসা করে উৎসাহিত করা। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা যিনি ঐ শ্রেণিতে পড়ান বিশেষ করে তারা পড়া না পারা ছাত্র বা ছাত্রীটির কাছে এমন ব্যবহার করবেন যাতে তার কাছে ছাত্র বা ছাত্রীটি নিজের সমস্যা খুলে বলতে পারে। সব শুনে তিনি সহজভাবে বুঝিয়ে দেবেন। আর কঠিন বা না বোঝা বিষয়গুলি সহপাঠী বন্ধুর কাছে বুঝে নেবার মতো সঙ্গী শিখনের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। সুপরামর্শের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীটির আত্মবিশ্বাস জাগাতে চেষ্টা করবেন।
৩।হতাশ ছাত্র বা ছাত্রী নিজে নিজে কী কী করতে পারে :-
আর হতাশ বন্ধুর প্রতি বলি , পড়া না পারা কঠিন মনে হওয়া বিষয়ের না-বোঝা অধ্যায়গুলি চিহ্নিত করে একটু সময় নিয়ে পড়ো , লেখো , বোঝার চেষ্টা করো। আগেই বলেছি শিক্ষক-শিক্ষিকা বা সহপাঠীর কাছে কঠিন বিষয়গুলি একটু আলোচনা করো। পড়া মনে রাখার কৌশলগুলি রপ্ত করে পড়ো ।আর কয়েকটি কথা সর্বদা মনে রাখবে-
i) পৃথিবীতে সবাই সমান নয় ।
ii) শুধুমাত্র পড়াশুনাতেই ভালো হলে সব ভালো হয় এমনটা নয় ।
iii) এমন অনেক মানুষ আছেন যারা পৃথিবীতে বিখ্যাত তাঁরাও পড়াশুনায় খুব খারাপ ছিলেন ।
iv) তোমার ভিতরে বিশেষ সম্ভাবনার বীজ রয়েছে । সেটাকে যত্ন কর ।
v) ভালো মানুষ হও- সেটাই দেশ সমাজ চায় – শুধু ভালো রেজাল্ট নয় ।
vi) যখন হতাশা জাগবে গান শোনো , ভালো বই পড়ো আবৃত্তি করো , ছবি আঁকো বা তোমার ভালোলাগা কোনো সৃজনশীল (creative) কাজ করো ।
vii) মনে রেখো তুমি সফল হবার কল্পনা করো , ব্যার্থতার ভয় রাখবেই না ।
viii) একবার পারো নি তো কী হয়েছে পরেরবার পারবেই -এটাকেই বিশ্বাস করে পড়া করো ।
ix) তুমি পারবে – পারবেই নিজেকে আত্মবিশ্বাসের শক্তি দাও ।
x) ভালো বন্ধু তৈরি করো – যে তোমায় বোঝে – উপহাস করে না – তার সঙ্গে প্রাণখুলে সব বলো ।
xi) ব্যঙ্গ,ঠাট্টা , অপমান শুনে যাও কখনো নিজেকে ছোট ভেবো না , এসবের প্রয়োজন আছে – কারন অন্ধকারই আলোর চাহিদা তৈরি করে ।
আর বন্ধু যারা পড়া না পারার জন্য হতাশ তারাও একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবেই। মোটামুটি যতটা সম্ভব ভালো রেজাল্ট করো আর জীবনের লক্ষ্য স্থির করো – ভালো মানুষ হবার স্বপ্ন দেখো – যাতে একটা দেশের -একটা সমাজের কাছে মূল্যবান মানুষ হিসেবে পরিণত হও তুমি । ভালো থেকো ।