ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০
মৃত্যু ও ২৯ জুলাই ১৮৯১
সর্বকালের সেরা বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্ত যথার্থই লিখেছিলেন —
” বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু !– উজ্জল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।” ( ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)
বাঙালি জাতীর গুরুদেব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত গর্বের সঙ্গেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন :– “দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষত্ব ।”
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্ম: মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ই আশ্বিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়। ইংরাজী ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর। সে সময় বীরসিংহ গ্রামটি হুগলী জেলার অন্তর্গত হলেও পরবর্তী সময়ে এই বীরসিংহ গ্রামটি মেদিনীপুর জেলা ভুক্ত হয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বংশ পরিচয়: পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মাতা ভগবতী দেবী। তাঁর ঠাকুরদার নাম ছিল রামজয় ভূষণ। পন্ডিত হিসেবে রামজয় তর্কভূষণের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল সে সময়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাল্য ও কৈশাের জীবনের দিনগুলি কেটেছিল চরম দারিদ্র ও অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে।
ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামের পাঠশালায় প্রথমিক শিক্ষা গ্রহন করেন। প্রথমে গাঁয়ের সনাতন পন্ডিত ও পরে কালিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি পাঠ গ্রহণ। পরবর্তীসময়ে বালক ঈশ্বরচন্দ্রের মেধা শক্তিতে অভিভূত হয়ে কালিকান্ত চট্টোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্রকে কলিকাতায় শিক্ষাদানের পরামর্শ দেন। ১২৫৩ বঙ্গাব্দের শেষে তিনি তার বাবার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে ভর্তি হন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে। ব্যাকারণে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। যথেষ্ট কৃতিত্বের সাথে পড়াশুনা করে মাসিক ৫টাকার বৃত্তি লাভ করেন। পরে ব্যাকরণ শ্রেণির পাঠ শেষ করে ইংরেজী শ্রেণির পাঠ শুরু করেন। যষ্ঠ শ্রেণিতে আবার বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন এবং পারিতােষিক লাভ করেন। ১৮৩৩-১৮৩৫ সাল পর্যন্ত সাহিত্য শ্রেণিতে পড়াশুনার সময় শিক্ষক জয়গােপাল তর্কলঙ্কারের শিক্ষা ও সান্নিধ্য লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজে বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৮৩৫ সালে আবার ভর্তি হন অলংকার শ্রেণিতে। খুব অল্প সময়েই অধ্যাপক প্রেমাচাঁদ তর্কবাগীশের তিনি প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠেন। পরে তিনি বেদান্ত শ্রেণিতে ও স্মৃতি শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। এখানেই তিনি প্রখ্যাত পন্ডিত হরনাথ তর্কভূষণ ও শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির সান্নিধ্য লাভ করেন। স্মৃতি শ্রেণিতে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি। ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি হিন্দু ল কমিটির’ পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হিন্দু ল কমিটির’ পরীক্ষার শেষে প্রদত্ত প্রশংসাপত্রে বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি তাঁর নামের আগে ব্যবহৃত হয়। কাব্য, অলংকার,বেদান্ত। স্মৃতি, ন্যায়শাস্ত্র এবং জ্যোতিষে তিনি বিপুল পান্ডিত্য অর্জন করেন।
পনের বছর বয়সে শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দিনময়ী দেবীকে বিয়ে ক’রে সংসার-জীবন শুরু করেন। বিদ্যাসাগরের এক ছেলে ও চার মেয়ে। নারায়ণচন্দ্র, হেমলতা, কুমুদিনী, বিনােদিনী ও সারৎকুমারী।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহিত্য সাধনা :- যথার্থই বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক ছিলেন বিদ্যাসাগর। স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথই তাঁকে “বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী” আখ্যায় সম্মানিত করেন। তাঁর উল্লেখযােগ্য অবদান সংস্কৃত ,হিন্দিী ও ইংরাজী, থেকে বহু গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করা। যেমন – ‘ভ্রান্তিবিলাস’ , ‘সীতার বনবাস’ , ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ তার অনুবাদ কার্যের উল্লেখযােগ্য স্বীকৃতি। এছাড়াও বর্নপরিচয়’, কথামালা’, ‘বােধোদয়’, অখ্যানমঞ্জুরী’, গ্রন্থণ্ডলি বাংলা শিক্ষার ধারক ও বাহক হিসাবে আজও বিবেচিত।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কর্মজীবন :- ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে ডিসেম্বর কলকাতার ফোর্টউইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিতের পদে নিযুক্ত হন। মাত্র ৫ বছর তিনি এখানে নিযুক্ত ছিলেন । পরে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৫০ টাকা বেতনে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সহকারি সম্পাদকের পদে নিযুক্ত হন। বিদ্যাসাগরের পক্ষে আত্মসম্মান অক্ষুন্ন রেখে কাজ করা অসম্ভব হওয়ায় ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ওই পদে ইস্তফা দেন।
পরে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে জানুয়ারী মাসিক ১৫০ টাকা বেতনের বিনিময়ের ওই কলেজের অধ্যক্ষের পদ লাভ করেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের কর্মনিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও কর্ম তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে বিদ্যালয় পরিদর্শকের দায়িত্ব দেন।
নারীদের শিক্ষার বিষয়টি তখনকার দিনে দারুনভাবে অবহেলিত ছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মেয়েদের মন থেকে অশিক্ষার অন্ধকার দূর করে শিক্ষার আলাে জ্বেলে দিতে না পারলে স্ত্রীজাতির সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে মেয়েদের জন্য ৩০টি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তৎকালীন ছােট লাট ফ্রেডারিক হ্যালিডে বিদ্যাসাগরের এমন উদ্যম ও দুঃসাহসী কর্ম প্রচেষ্টায় অভিভূত ও মুগ্ধ হন।
তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজসংস্কারক। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। এই মহান কর্ম প্রচেষ্টায় রূপায়ণে তাকে প্রতি পদে পদে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবু তিনি পিছপা হননি। সমস্ত বাধা তিনি কঠোর হাতে দমন করেছেন। এবং এই আইনের বাস্তব প্রয়াসের উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপনে তিনি নিজপুত্র নারায়ণচন্দ্রের সাথে ১২৭৭ সালের ২৭ শে শ্রাবণ ভবসুন্দরীর বিবাহ দেন। তিনি বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথা রদ করেছিলেন।
সম্মানলাভ :১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইংলন্ডের রয়েল এশিয়াটিক সােসাইটির তিনি সভ্য নির্বাচিত হন। ভারত সরকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ১৮৮০ খ্রষ্টাব্দে সি আই ই’ উপাধিতে সম্মানিত করেন।
তিরােধান: ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে মাতা ভগবতী দেবীর এবং ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে পিতা ঠাকুরদাসের মৃত্যু হয়। ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম থেকেই বিদ্যাসাগর খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে জুলাই বাংলা ১২৯৮ সনের ১৩ ই শ্রাবণ মাত্র ৭১ বছর বয়সে রাত দুটো আঠারাে মিনিটে এই মহান কর্মযােগী মহামানবের স্বর্গলাভ ঘটে ।
বর্ণপরিচয় (১ম ভাগ)১৮৫১, বর্ণপরিচয় (২য় ভাগ)
, কথামালা , বােধোদয় , বেতাল পঞ্চবিংশতি, জীবনচরিত, সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব ,(বিজ্ঞাপন) , অতি অল্প হইল (বিজ্ঞাপন) , আবার অতি অল্প হইল , বিদ্যাসাগর রচিত শব্দ মঞ্জরী , শকুন্তলা , ভ্রান্তিবিলাস, সীতার বনবাস , ব্রজবিলাস, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (বিজ্ঞাপন) , বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (পুস্তক ), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (পুস্তক ) , বাঙ্গলার ইতিহাস ইত্যাদি ।
১। “এদেশের উদ্ধার হইতে বহু বিলম্ব আছে। পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাতপুরু মাটি তুলিয়া নতুন মানুষের চাষ করিতে পারিলে তবে এদেশের ভাল হয়।”
২। “যে ব্যক্তি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেন, সে দেশের হিতসাধনে সাধ্যানুসারে সচেষ্ট ও যত্নবান হওয়া তাহার পরম ধর্ম ও তাহার জীবনের সর্বপ্রধান কর্ম।”
৩। ” মনের ঐক্যই প্রণয়ের মূল । সেই ঐক্য বয়স, অবস্থা, রূপ, গুণ, চরিত্র, বাহ্য-ভাব ও আন্তরিক-ভাব ইত্যাদি নানা কারণের উপর নির্ভর করে। অম্মদেশীয় বালদম্পতিরা। পরস্পরের আশায় জানিতে পারিল না, অভিপ্রায়ে অবগাহন করিতে অবকাশ পাইল না ।”
আশা করি বন্ধুরা আজকের লেখাটি থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সম্পর্কে মূল্যবান কিছু জানতে পারলাম আমরা । এরকম আরো লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক করে সঙ্গে থাকুন । আর পেতে থাকুন এরকম লেখাগুলো ।