ইকিগাই কি ?
আপনি কেন বেঁচে আছেন ? কিংবা পৃথিবীতে আপনার অস্তিত্বের কারণ কী ? কোন কাজটিতে আপনি আপনার জীবনের অর্থ এবং উদ্দেশ্য খুঁজে পান ? যেটা আপনাকে অনাবিল আনন্দ দান করে থাকে, যা আপনার রোজ সকালে বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠার কারণ। হ্যা এই প্রশ্ন গুলোর সঠিক উত্তর দেবে আপনার ইকিগাই।
শব্দটা ছোট্ট কিন্তু, মানেটা গভীর। এটি একটি জাপানি কনসেপ্ট। যার উৎপত্তি জাপানি দ্বীপপুঞ্জ ওকিনাওয়ার একটি গ্রামে। এর অর্থ হল, ‘জীবনের মূল্য’। জাপানি ভাষায় ‘ইকি’ মানে জীবন আর ‘গাই’ মানে দাম বা মূল্য। যোগ করলে দাঁড়ায়, জীবনের মূল্য বা বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। যা আপনাকে রোজ অনুপ্রাণিত করে।
ওকিনাওয়া দ্বীপের এই গ্রামটির নাম ওগিমি এবং এর ৩,০০০ বাসিন্দাদের সবাই পৃথিবীতে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী মানুষ হিসেবে বিখ্যাত। বাসিন্দাদের সকলেই বাঁচেন ১০০ বছর বা তার বেশী। এখানে হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মত রোগ-ব্যাধির সংখ্যা খুবই কম, এবং এখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্মৃতিভ্রষ্টতাও অনেক কম লক্ষ্য করা যায়। তাঁদের দীর্ঘজীবী হবার ও সুস্থতার কারণ হলো তারা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করে থাকেন; তাদের বিষয় সম্পত্তির পরিমান খুবই সামান্য, তারা ঘরের বাইরে প্রচুর খেলাধূলা করে , বন্ধু-বান্ধবের সাথে সময় কাটান, পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর এবং হালকা খাবার সেবন করেন।
ড্যান বুয়েটনার : ব্লু জোনসের লেখক : দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের কাছ থেকে জীবন যাপনের বিষয়ে পাঠগুলি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে , তারা বিশ্বাস করেই এটি করে থাকেন ।
বুয়েটনার মতে,ইকিগাই এর ধারণা ওকিনাওয়ানদের কাছে একচেটিয়া নয়: “এর জন্য কোনও প্রচলিত পরিভাষার শব্দ নাও থাকতে পারে , তবে সার্ডিনিয়া এবং নিকোয়া উপদ্বীপের মতো চারটি নীল অঞ্চলগুলিতে একই ধারণা দীর্ঘজীবী মানুষের মধ্যে রয়েছে।”
বুয়েটনার তিনটি তালিকা তৈরি করার পরামর্শ দেন :
১.আপনার মূল্য
২.আপনি করতে পছন্দ করেন এমন জিনিস এবং
৩. আপনি যে জিনিসগুলিতে খুব ভাল।
—– এই তিনটি তালিকার সম্মিলিত বিভাগটিই আপনার ইকিগাই।
Ikigai: The Japanese Secret to a Long and Happy Life” নামক বইয়ের লেখক হেকটর গার্সিয়া এবং ফ্রান্সেস মিরেলেস জাপানের ওগিমি গ্রামের বয়স্ক বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার নেন এবং তাদের সকলের ইকিগাই সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। তাদের মতে- “আমাদের ইকিগাই হলো আমাদের সকালে ঘুম থেকে ওঠার কারণ।”
“আমি নিজেই নিজের সবজি বুনি এবং নিজেই তা রান্না করি” “আমার বন্ধুদের সাথে মিলিত হওয়া”
“আমি কঞ্চি দিয়ে জিনিস বানাই।” — এইসমস্ত বিষয়গুলো উঠে আসে তাদের কথায় ।
“Ikigai is what gets you up every morning and keeps you going.“
লেখক হেক্টর গার্সিয়া বলেন-“আপনি যে কাজে দক্ষ আর আপনি যে কাজ করতে পছন্দ করেন, এই দুইয়ের মাঝেই অবস্থান করছে আপনার ইকিগাই।”
তিনি লিখেছেন,
সময়ের সাথে সাথে মানুষের যেমন বস্তু এবং অর্থের প্রতি লোভ লালসা বেড়েছে, তেমনি কিছু মানুষ অর্থ এবং খ্যাতির নিরলস সাধনায় অসন্তুষ্টি অনুভব করছে এবং তার পরিবর্তে তারা তাদের নিজস্ব ধন-সম্পদের চেয়ে বড় কিছুতে মনোনিবেশ করছে। বছরের পর বছর ধ’রে এটি বিভিন্ন ধরণের শব্দ দ্বারা এবং অনুশীলন প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, তবে বিষয়টি সর্বদা জীবনের অর্থবোধের কেন্দ্রীয় মূলকেই নির্দেশ করে।
ইকিগাই হচ্ছে আপনার কাজটি যা আপনাকে মারাত্মকভাবে সুখী রাখবে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। এবং এটা ঠিকমত করতে পারলে আপনি সম্ভবতঃ জীবনের শেষদিকে বাঁচার জন্য পাবেন কিছু অতিরিক্ত বছর।
ইকিগাই কে চারটি প্রাথমিক উপাদানের রূপান্তর
হিসাবে দেখা হয়:
১.আপনি কী ভালবাসেন (আপনার আবেগ)
২.বিশ্বের কী প্রয়োজন (আপনার লক্ষ্য)
৩.আপনি কোন কাজে পারদর্শী (আপনার বৃত্তি)
৪.আপনি এর জন্য কতটা উপার্জন করতে পারেন?
আপনি যখন এই প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর পাবেন তখন জানবেন সেটাই আপনার ইকিগাই।
আপনার নিজের ইকিগাই আবিষ্কার করা হলে তা আপনার জীবনে সুখ নিয়ে আসবে এবং আপনাকে আরও দীর্ঘায়িত করে তুলবে।
Ikigai is about feeling your work makes a difference in people’s lives
আপনার ইকিগাই খুঁজে পেতে চান ? নিজেকে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি করুন-
১. আমি কী ভালোবাসি ?
২. আমি কীসে দক্ষ ?
৩. পৃথিবীর কী দরকার ?
৪.আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন কেন আপনি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠেন ?
৫.“আপনাকে কোন বিষয়টি অনুপ্রাণিত করে ?”
আপনাকে আপনার ইকিগাই খুঁজতে হবে ছোট ছোট জিনিসের মাঝে। আপনাকে অবশ্যই ছোট কাজ থেকেই শুরু করতে হবে।
আপনি যখন ইকিগাই খুঁজে পাবেন তখন আপনি যদি ১০০ বছর নাও বাঁচেন তথাপি আপনার কাছে আপনার জীবনকে মনে হবে সুদীর্ঘ । কারণ আপনি একে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। এবং জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেলে আপনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারি হবেন এবং আপনার জীবনটা আনন্দে ভরে উঠবে।
কয়েক লক্ষ মানুষের সমস্যা হ’ল তারা দায়বদ্ধতাগুলি গ্রহণ করে থাকেন এবং রুটিনগুলি তৈরি করার সাথে সাথে তারা নতুন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আগ্রহী হওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে তারা বেঁচে থাকার আসল রসদটি খুঁজে পায় না।
গার্সিয়া ও মিরেলেস বলেন-
“আধুনিক জীবনধারা আমাদেরকে আমাদের সত্যিকারের চরিত্র থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের অনেকেই একটি অর্থহীন জীবন ধারণ করছি।”
“আপনার মধ্যে প্রচন্ড আবেগ আছে, একটি নিজস্ব প্রতিভা আছে যা আপনার প্রতিদিনের জীবনের অর্থ খুঁজে দেয় এবং আপনাকে আপনার সবচেয়ে ভালটি করতে অনুপ্রাণিত করে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ।”
“Ikigai: The Japanese Secret to a Long and Happy Life” নামক বইয়ের লেখক হেকটর গার্সিয়া এবং ফ্রান্সেস মিরেলেস
দশটি প্রণালীর কথা বলেছে যা কারও নিজস্ব ইকিগাই খুঁজে পেতে সহায়তা করতে পারে-
১.সক্রিয় থাকুন এবং অবসর গ্রহণ করবেন না।
২. তাত্ক্ষণিকতার পিছন ত্যাগ করুন এবং জীবনে ধীর গতি অবলম্বন করুন।
৩. পরিমিত আহার করুন, এবং খাদ্য তালিকায় প্রচুর পরিমাণ শাক সবজি রাখুন। ৮০ শতাংশ পেট পূর্ণ হলেই খাওয়া ত্যাগ করুন।
৪. সর্বদা ভাল বন্ধুদের সঙ্গে নিজেকে ঘিরে রাখুন।
৫. দৈনিক মৃদু অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে সক্রিয় রাখুন।
৬. হাসুন এবং আপনার চারপাশের লোকদের স্বীকৃতি দান করুন।
৭ .প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করুন।
৮. ধন্যবাদ জ্ঞাপন করুন সেই সব জিনিসের প্রতি যা আপনার দিনটিকে উজ্জ্বল বানায় এবং এবং আপনাকে উজ্জীবিত রাখে ।
৯. বর্তমানে থাকুন।
১০. আপনার ইকিগাইকে অনুসরণ করুন।
আমাদের ইকিগাই আমাদের সবার জন্য আলাদা, তবে একটি বিষয় আমাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে তা হল আমরা সবাই জীবনের অর্থ অনুসন্ধান করছি। যখন আমরা আমাদের দিনগুলিকে আমাদের কাছে অর্থপূর্ণ বলে মনে করি তখনই আমরা আরও পরিপূর্ণভাবে বাঁচি; যখন আমরা জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলি, তখনই আমরা হতাশাবোধ করি ।
তবে সকলের ইকিগাই যে একই হবে তার কোনো মানে নেই । বিভিন্ন মানুষের ইকিগাই বিভিন্ন হতে পারে। আপনার ইকিগাই হতে পারে বন্ধুদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো , গান করা , খেলা করা, একজন ভাল বাবা/মা হওয়া, লেখালেখি করা, ছবি আঁকা , মানুষের পাশে দাঁড়ানো, অসহয়কে সহায়তা করা , যে কাজটি করতে ভালবাসেন সেটিই করুন, সবসময় আপনার ভালবাসার মানুষদের সাথে থাকুন এবং আপনার অন্তরের কম্পাসের প্রতি মনোযোগী হোন। আপনার ভিতরে একটি আবেগ রয়েছে, একটি অনন্য প্রতিভা যা আপনার দিনগুলিকে অর্থ দেয় এবং আপনাকে শেষ অবধি নিজের সেরাটি ভাগ করে নিতে উৎসাহিত করে। আপনার ইকিগাই এখনও কী তা আপনি যদি জানেন না, যেমন ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল বলেছেন, “আপনার লক্ষ্যটি হলো এটি আবিষ্কার করা। ” – ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল ( ম্যানস্ সার্চ ফর মিনিং)
আশাকরি বন্ধুরা আজকের লেখাটি থেকে খুব ভালো কিছু জানতে পারলাম আমরা । এরকম আরো লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক করে সঙ্গে থাকুন । আর পেতে থাকুন এরকম লেখাগুলো ।