ট্রাইগ্লিসারাইড হলঃ এক ধরনের চর্বি (লিপিড) যা আপনার রক্তে পাওয়া যায়। খাদ্যতালিকার অধিকাংশ চর্বিজাতীয় পদার্থগুলিই হল ট্রাইগ্লিসারাইড, যেগুলি প্রাথমিকভাবে ফ্যাট বা চর্বি কোষে জমা হয় এবং পরে মুক্ত হয়ে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তপ্রবাহে ট্রাইগ্লিসারাইডের উচ্চমাত্রা, যা হাইপারট্রাইগ্লিসারাইডিমিয়া নামেও পরিচিত, শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকারক হতে পারে।
স্বাভাবিক সীমা- নিম্ন ঝুঁকি — প্রতি ডেসিলিটারে ১৫০ মিলিগ্রামের কম (mg/dL), বা প্রতি লিটারে ১.৭০ মিলিমোলের কম (mmol/L)
স্বাভাবিক সীমার চেয়ে সামান্য বেশি — ১৫০ থেকে ১৯৯ mg/dL (১.৭০ – ২.২৫ mmol/L)
উচ্চ — ২০০ থেকে ৪৯৯ mg/dL (২.২৬ – ৫.৬৫ mmol/L)
অতি উচ্চ বা ঝুঁকিপূর্ণ— ৫০০ mg/dL বা তার বেশি (৫.৬৫ mmol / L বা তার বেশি)
আপনার রক্ত প্রবাহে উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা শনাক্ত করার জন্য লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়। ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা উপবাসের পরে রক্তে ট্রাইগ্লিসেরাইডের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। আহারের পরে রক্তে ট্রাইগ্লিসেরাইডের মাত্রা সাময়িকভাবে বেশি থাকে।
American Heart Association হৃৎপিণ্ডের সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে রক্তে ট্রাইগ্লিসেরাইডের মাত্রা ১০০ মিগ্রা/ডেসিলিটার (১.১ মিলিমোল/লিটার) বা তার কম রাখতে সুপারিশ করেছে।
রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে গেলে প্যানক্রিয়াটাইটিস,স্ট্রোক, ফ্যাটি লিভার ইত্যাদি হতে পারে।
ট্রাইগ্লিসারাইড এর প্রধান লক্ষণ বা ট্রাইগ্লিসারাইডের উপসর্গগুলি কি কি ?
সাধারণত উচ্চ মাত্রার ট্রাইগ্লিসারাইডের নির্দিষ্ট কোনও উপসর্গ থাকে না। কিন্তু ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা যদি স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায় তবে তা রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমন:-
আর্টেরিওস্কেলেরোসিস – রক্তবাহক ধমনিগুলিকে সংকীর্ণ এবং কঠিন করে তোলে।
করোনারি হার্ট ডিজিজ – হৃৎপিন্ডের রক্তবাহক ধমনীগুলিকে কঠিন এবং সংকীর্ণ করে তোলে।
স্ট্রোক – মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। হার্ট, ব্রেনে যে কোনও ধরনের স্ট্রোকের মূলে থাকতে পারে রক্তনালিতে অতিরিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইডের জমে যাওয়া।
প্যানক্রিয়াটাইটিস – যেটি গুরুতর পেটে ব্যথার কারণ হয়।
কিডনি – কিডনির ক্ষতিও হতে পারে।
Read More : খেজুরের উপকারিতা ও অপকারিতা
স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট, মিষ্টি জাতীয় খাবার প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড, ধূমপান, অ্যালকোহল, শরীরচর্চায় অনীহা, মানসিক চাপ, ডায়াবিটিস, কিডনির অসুখ ইত্যাদি ট্রাইগ্লিসারাইডকে বাড়িয়ে দেয় অনেকটা। ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি হওয়া মানে ধরে নিতে হবে শরীর ঠিক মতো তার শক্তিক্ষয় বা শক্তিসঞ্চয় করছে না।
ট্রাইগ্লিসারাইড এবং কোলেস্টেরল উভয়েই লিপিড, কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির যা রক্তে প্রবাহমান থাকে। উভয়েই শরীরে তৈরি হতে পারে।
ট্রাইগ্লিসারাইড ও কোলেস্টেরল দুটোই অনেকটা বেশি হয়ে গেলে দুটোই আলাদা ভাবে হৃদযন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রাইগ্লিসারাইড এবং কোলেস্টেরল এর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল ট্রাইগ্লিসারাইড অব্যবহৃত ক্যালোরি সঞ্চয় করে এবং আপনার শরীরকে শক্তি সরবরাহ করে আর কোলেস্টেরল কোষ এবং নির্দিষ্ট হরমোন তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
হাই ট্রাইগ্লিসারাইড বিভিন্ন রোগের কারণে হতে পারে।
দৈনিক ক্যালরি খরচের তুলনায় ক্যালরি গ্রহনের পরিমান বেশি হলে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিস
হাই ব্লাড প্রেসার
ওবেসিটি
কিডনি রোগ
প্রচুর মদ্যপান
থাইরয়েড হরমনের পরিমান কমে যাওয়া,
কিছু জেনেটিক অবস্থা যা ফ্যাট থেকে শক্তি তৈরিতে বাধা দেয়। এছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনের কারণে হতে পারে, যেমন-বিটা ব্লকার,ডায়রিউটিকস ইস্ট্রোজেন,জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি, স্টেরয়েড, ইত্যাদি।
১. প্রচুর পরিমাণে শাক সবজি খেতে হবে :- সবজি এবং ফলমূল শরীরের জন্য উপকারী। রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে খাদ্যতালিকায় প্রতিদিন প্রচুর সবুজ ও রঙিন শাকসবজি এবং তাজা মৌসুমি ফলমূল রাখতে হবে।
২. চিনি কম খান – অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যারা নিয়মিত চিনি ও মিষ্টিযুক্ত পানীয় গ্রহণ করেন তাদের উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইড হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ বেশি অন্যদের তুলনায়।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন – আপনি যখন আপনার শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্যালরি গ্রহণ করেন তখন আপনার শরীর সেই ক্যালরিগুলোকে ট্রাইগ্লিসারাইডে পরিণত করে এবং চর্বি কোষগুলোকে সঞ্চয় করে। অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ কমিয়ে ও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমানো একটি কার্যকর উপায়।
৪. স্বাস্থ্যকর ফ্যাট বেছে নিন :- কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড কমানোর সহজ উপায় হচ্ছে সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত এবং অতিরিক্ত কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার পরিহার করা। সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার যেমন রেডমিট (গরু, ছাগল বা এই জাতীয় প্রাণীর মাংস)কম খান। তার পরিবর্তে অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা উচিত, যেমন- সয়াবিন তেল, সূর্যমুখী তেল, জলপাইয়ের তেল, মাছ ইত্যাদি।
৫. অ্যালকোহল পান এড়িয়ে চলুন :- অ্যালকোহলে ক্যালোরি এবং চিনি বেশি থাকে এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের উপর বিশেষভাবে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। আপনার যদি গুরুতর হাইপারট্রাইগ্লিসারাইডেমিয়া থাকে তবে অ্যালকোহল পান করা এড়িয়ে চলুন।
৬. ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন :-
গবেষকেরা বলেছেন, ওমেগা–৩ রক্তে ট্রাইগ্লসারাইডের পরিমাণ এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা কমায়। খাদ্যতালিকায় প্রতিদিন বাদাম রাখতে হবে। বাদামে প্রচুর ওমেগা-৩ এবং মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে। সামুদ্রিক মাছের তেলেও প্রচুর ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। তাই এই তেল শরীরের জন্য ভাল।
৭. ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন :- নিয়মিত ব্যায়াম রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে ভীষণ কার্যকরী। দিনে পঁয়ত্রিশ মিনিট জোরে টানা হাঁটুন। এ ছাড়া সাইক্লিং, সাঁতার, সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামাও ভাল। যদি ব্যায়ামাগারে যাওয়ার অভ্যাস থাকে কিংবা ঘরে ব্যায়ামের উপকরণ থাকে তবে ১৫ মিনিটের ধীর গতির শরীরচর্চায় কোলেস্টেরল কমানো সম্ভব। কোলেস্টেরলে থাকা ট্রাইগ্লিসারাইড দেহে শক্তি হিসেবে খরচ হয়। ব্যায়াম করলে ট্রাগ্লিসারাইড খরচ হয় ফলে এর মাত্রা কমে।
ট্রাইগ্লিসারাইড কী লেখাটি কেমন লাগলো তা আমাদের কমেন্টে জানাও। ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটি ফল করো।