স্টোয়িক দর্শন ও দার্শনিক সেনেকা । Stoic Philosophy & Seneca
স্টোয়িক দর্শন ও দার্শনিক সেনেকা
আত্মোপলব্ধি ও আত্মোন্নয়নের জন্য আপনি যদি তৎপর হয়ে থাকেন , দেখবেন প্রায় সবাই আপনাকে বলবেন, হয় সন্ন্যাসী হয়ে যান , নয়তো পেশা , কাজ কর্ম সংসারের ঝামেলা থেকে আগে নিজেকে মুক্ত করুন । তারপর ভাবুন আত্মোন্নয়নের কথা । কিন্তু তার বদলে যদি আপনাকে বলা হয় আপনি আপনার পেশা, সংসার কাজের মধ্যে থেকেও আত্মোপলব্ধি ও আত্ম- উন্নয়ন করতে পারেন । তাহলে কেমন হয় ? হ্যাঁ বন্ধুরা । এমনটাই বলা হয় স্টোয়িক দর্শনে । তাহলে স্টোয়িক দর্শন কী ? এর মূল কথাই বা কী ? আর কবে কোথায় এই দর্শনের উৎপত্তি ? এই প্রশ্নগুলির উত্তর জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে স্টোয়িক দর্শনের জন্ম সম্পর্কে ।
স্টোয়িক দর্শনের উৎপত্তি:-
প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সিটিয়াম প্রদেশের জেনো-কেই স্টোয়িক দর্শনের জনক বলা হয়। সিটিয়ামে একটি আর্ট গ্যালারির আয়োজন করা হয় যার নাম ছিল “স্টোয়া পয়কিলে”। সেখানেই এই দর্শনের মূল তত্ত্বটিকে জেনো প্রথম তুলে ধরেন । আর এই “স্টোয়া” নামটি থেকেই এই দর্শনের নাম স্টোয়িসিজম । জেনোর পরে এই দর্শন মূলত তিন দার্শনিক– এপিক্টেটাস, সেনেকা ও অরেলিয়াস হাত ধরে প্রচার লাভ করে।
স্টোয়িক দর্শন এর মূল নীতিগুলো হল:-
১. আমাদের চারপাশ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত।
২.কোন কাজ করার পূর্বে কিংবা কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমদের চিন্তা ভাবনা কেমন হওয়া দরকার।
কারণ আমাদের মঙ্গল ও কল্যাণ নিয়ন্ত্রিত হয় ইতিবাচক চিন্তা ও স্বভাবের দ্বারা।
৩.আমাদের ইচ্ছাশক্তি উপর নিজেদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা।
কোন জিনিসগুলি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং কোন জিনিসগুলি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই সেই বিষয়ে সঠিক ধারণা রাখা। কারণ নিজের অন্তর্জগতকে নিয়ন্ত্রণ ও রূপান্তর করতে সক্ষম হলে মানুষের জীবনযাপনের মানও সাধারণ থেকে অসাধারণ স্তরে পৌঁছবে।
আমরা বেশীরভাগ সময়ই বাহ্যিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকি। কিন্তু স্টোয়িকবাদ অনুযায়ী, আমাদের জীবন আসলে কোনো বাহ্যিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয় না, বরং সে ঘটনাটিকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে আমরা কীভাবে নিচ্ছি, তার ওপরই নির্ভর করে সমস্ত কিছু। অর্থাৎ আমাদের ইতিবাচক অবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। জীবন ঘটনার সমারোহ। কখন কী ঘটে যাবে আমরা হয়তো কেউ জানি না। কারণ বাইরের সব কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু সেই পরিস্থিতির ওপর আমাদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত সেটা পুরোটাই আমাদের হাতে থাকে। মানুষ মনোভাবের পরিবর্তন ঘটিয়ে তার জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
স্টোয়িক দার্শনিকদের মতবাদ:-
যেমন স্টোয়িক দর্শনের জনক জেনো বলেন-
“মঙ্গল সাধিত হয় ছোটোর সাথে ছোটো জোড়া লেগেই। তাই কোনো কিছুই আদতে ‘ছোটো’ নয়।” – জেনো
জীবনের অর্জনগুলিকে ‘ছোট’ বলে আখ্যা দিতে নারাজ স্টোয়িকবাদীরা। বড় বড় অর্জনগুলি আসলে ছোট ছোট কর্মের দ্বারাই অর্জিত হয়। একটি চারাগাছ একদিনেই মহীরুহে পরিণত হয় না। তেমনি একটি শিশুও একদিনেই দাঁড়াতে পারে না। হাজার মাইলের যাত্রা শুরু হয় একটি পদক্ষেপ দিয়ে। তাই কোনো জিনিসই ছোট নয়। ছোট ছোট কাজের মাঝেই বিশালতা লুকিয়ে থাকে।
এপিকটেটাস বলেন-
“তিনিই একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি, যা তাঁর কাছে নেই তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন না, তবে যা আছে তা নিয়ে তিনি আনন্দিত।” –এপিকটেটাস
স্টোয়িক মতবাদে বিশ্বাসী এপিকটেটাস মনে করেন আমার আমাদের জীবনের বেশীরভাগ সময়ই জীবনে কী কী পেলাম না তার হিসেব নিকেশ করে দুঃখ প্রকাশ করে থাকি। আমাদের কাছে কী কী আছে সেটা দেখি না। কিন্তু একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি জীবনে কী কী পেয়েছেন সেটা নিয়ে খুশি থেকে জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
“ব্যর্থতা হচ্ছে স্বাভাবিক, আক্ষেপ হলো নিরর্থক।” – মার্কাস অরেলিয়াস
ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাবার কথা বলে স্টোয়িকবাদ। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সাফল্যের পথে এগোতে হবে।
“প্রতিটি দিন এমনভাবে যাপন করো, যেন এটিই তোমার শেষ দিন।” – সেনেকা
এটাই স্টোয়িকবাদীদের জীবনদর্শন। তাঁরা সময়ের মূল্যের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। আজ যদি শেষ দিন হয় জীবনের, তাহলে কী কী করে যেতে চাইবো আমি ? এই প্রশ্নটা নিজেকে করলে হয়তো আমরা প্রতিটা সেকেন্ড পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবো।
আরও পড়ুন : লিও টলস্টয়ের জীবনী ও বিখ্যাত বাণী ও উক্তি সমূহ
সেনেকার জন্ম ও শৈশব:-
বর্তমান স্পেনের কর্ডোবায় খ্রিস্টের জন্মের ৫ বছর পরে জন্মেছিলেন রোমান দার্শনিক সেনেকা। তাঁর পুরো নাম লুইস অ্যানিয়াস সেনেকা। তবে বিশ্বে তিনি সেনেকা নামেই পরিচিত। বর্তমান স্পেনের কর্ডোবায় জন্ম গ্রহন করলেও শৈশবেই পরিবার সমেত তাঁরা রোমে চলে আসেন। তিনি তাঁর মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দর্শনের জগতে প্রবেশ করেন। শৈশব-কৈশোরে অ্যাটালাস ও সোশনের কাছে অলঙ্কারশাস্ত্রের সাথে স্টোয়িক পাঠও নিয়েছিলেন সেনেকা। তিনি রোমান সম্রাট নীরুর গৃহশিক্ষক ও উপদেষ্টা ছিলেন।
সেনেকার মৃত্যু:-
কথিত আছে ৬৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গায়াস কালপার্নিয়াস পিসো আর তার সঙ্গে সেনেকার ভাতিজা লুকান নামে একজন, তারা মিলে নিরোকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার চক্রান্ত করেছিল। পরে সেই চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যায়। সেনেকার ভাতিজার সূত্র ধরেই জড়িয়ে যায় সেনেকারও নাম। ফলে নিরোকে হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে সেনেকাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় সম্রাট নিরো। নিজের শিক্ষাগুরুর মৃত্যুদণ্ডের সাজা সহজ করে গুরু সেনেকাকেই বলা হল কষ্টকর আত্মহত্যা করতে। সেনেকা প্রথমে হাতের রগ কাটেন। তাতেও তার মৃত্যু হলো না, পরে হেমলক বিষ পান করলেন, তাতেও মরলেন না । এবারে সেনেকা সেনাদের বললেন তোমরা এবারে আমাকে গরম জলে ডুবিয়ে হত্যা করো। এইভাবে খুব করুন ভাবে দার্শনিক সেনেকার জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল।
সেনেকার সৃষ্টি:-
যখন সম্রাটের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন , তখন সেনেকা রাজনৈতিক প্রহসন লিখেছিলেন যার নাম ‘দ্য আপোকোলোসিন্টোসিস’ এবং আরেকটি নাটক যার নাম ‘ফিড্রা’। অবসরের পরেও তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেন । যার মইধ্যে রয়েছে ট্র্যাজেডি নাটক ও গল্প। সেগুলি হল ‘দ্য ট্রোজান উইমেন’, ‘দ্য ফিনিশিয়ান উইমেন’, ‘দ্য ম্যাড হারকিউলিস’ এবং‘মেডিয়া’। তাঁর ট্রাজেডির মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ছিল ‘ইডিপাস’ ও ‘আগামেমনন’। সেনেকার লেখা আরেক মূল্যবান বই হল ‘লেটারস ফ্রম এ স্টোয়িক ‘।
সেনেকা ৪৯ খ্রিস্টাব্দে পলিনাস নামে একজন রোমান রাজকর্মচারীকে উদ্দেশ্য করে ‘On the shortness of life” লিখেছিলেন। ল্যাটিন ভাষায় বইটির শিরোনাম ছিল ‘De Brevitate vitae। বইটি একটি সেরা মৌলিক কর্ম বলে বিবেচিত। স্টোয়িক চিন্তাচেতনা নিয়ে তার নিজস্ব জীবনদর্শন উঠে এসেছে এই গ্রন্থে। এ ছাড়াও স্টোয়িকবাদ নিয়ে সেনেকার বিশেষ বিশেষ ভাবনাগুলো প্রকাশ পেয়েছে মাকে ও লুসিয়াসকে লেখা তাঁর প্রায় ৬৯টি চিঠির মধ্যে ।
“They lose the day in expectation of the night, and the night in fear of the dawn.”- Seneca
“Life is long if you know how to use it. “-seneca
সেনেকা তাঁর ‘On the shortness of life’ বইটিতে বলেছেন মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হল সময়। এই স্বল্পমেয়াদি জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে চাইলে সময়ের সঠিক ব্যবহার করা উচিত এই বিষয়ে কার্যকরী উপদেশ দিয়েছেন সেনেকা। কারণ হাতের মুঠো থেকে বালি যেমন আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে, ঠিক তেমনই সময়ও আমাদের মুঠো করা জীবন থেকে প্রতিমুহূর্তে হারিয়ে যায়। আর কখনো ফেরে না। আমরা সময় গুলো কাটাই মাত্র – উদযাপন করি না। আমরা ভাবি আমরা চিরকাল বেঁচে থাকবো। মৃত্যু চিন্তা আমাদের মনে ভয়ের উদ্রেক করে। পৃথিবীতে সবকিছু অনিশ্চিত হলেও একমাত্র নিশ্চিত বিষয় হলো মৃত্যু। সেনেকার মতে- ‘‘তুমি এমনভাবে সময় অপচয় করো যেন তোমার অফুরান যোগান আছে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো কোনো দিন কাউকে যে সময়টা দিলে বা যে জন্য দিলে সেটা হয়তো তোমার শেষ সময়। মরণশীল প্রাণীর সব ভয় তোমাদের মধ্যে, কিন্তু তোমাদের আকাঙ্ক্ষা এত যেন তোমরা মরবে না।” মানুষকে কম সময় দেওয়া হয়েছে এই মতবাদে বিশ্বাসী নয় সেনেকা। তিনি মনে করেন আমরা আমাদের সময়ের বড় অংশটাই অপচয় করি। সময়ের সৎব্যবহার করেই অনেক বড় বড় কাজ করা সম্ভব। সময়ের ওপর কর্তৃত্ব যে আসলে জীবনের ওপর কর্তৃত্ব একথা যারা জানে না, তারা তাদের নিজেদের ভেতরে যে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে , তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। সেনেকা প্রকৃত বেঁচে থাকা বলতে বুঝিয়েছেন এমন এক জীবন যেখানে নিজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
মানুষ সর্বদা অন্যের সামনে নিজেকে তুলে ধরতেই জীবনের একটা বড় অংশ নষ্ট করে। সে অনেকের কাছেই পরিচিত হলেও দেখা যায় আসলে সে নিজের কাছে অপরিচিত। অন্যের মত করে বাঁচতে কিংবা অন্যের জীবন বাঁচতে বাঁচতে নিজের জীবনটা আর বাঁচা হয় না। অন্যকে সুখী করতে , আর অন্যের সামনে নিজেকে সুখী হিসেবে তুলে ধরতে ধরতেই মানুষের জীবন সায়াহ্নে এসে উপনীত হয়। তখন দেখা যায় সে আসলে জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পায়নি। নিজেকেই জানতে পারে নি। সেনেকার মতে- ” যারা তোমাকে তাদের দিকে ডেকে নেয় তারা আসলে তোমার কাছ থেকেই সরিয়ে নেয়।”
সেনেকা বলেন – “জীবন হচ্ছে এক রঙ্গমঞ্চ এখানে দীর্ঘতা নয় অভিনয় এর উৎকৃষ্টতাই আসল জিনিস হিসাবে গণ্য হয়।”
সেনেকার আমাদের যা শেখায় তা হল-
১.একদিন সব পাবো ব’লে বর্তমানকে অবহেলা ক’রে জীবনকে নষ্ট ক’রো না।
২. পূর্বের কৃতকর্মের অনুশোচনা করে কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তা করে বর্তমানের জীবনকে নষ্ট ক’রো না।
৩. সৃষ্টিকর্তা মানুষকে যেমন সময় বেশি দেন নি, তেমনি সময় কমও দেয় নি। শুধু সময়কে কাজে লাগাতে দিয়েছেন ।
৪. এমন ভাবে বাঁচো যেন আজকের দিনটাই শেষ দিন।
স্টোয়িক দর্শন লেখাটি আশা করি ভালো লাগবে। ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটিকে ফলো করো।