তুলসী পাতার উপকারিতা ও গুণাগুণ
তুলসী পাতা আমাদের সকলেরই কাছে খুবই পরিচিত একটি পাতা। তাই তুলসী পাতার গুণাগুণ সম্পর্কে আমরা কম বেশি ওয়াকিবহাল। তুলসী হল একটি ঔষধী গাছ, যাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভান্ডার হিসেবে ধরা হয়। যার বৈজ্ঞানিক নাম হল ‘Ocimum Sanctum’। তুলসী কথার অর্থ হল যার তুলনা নেই। ইংরেজিতে একে ‘হলি বাসিল’ বলা হয়ে থাকে। এই পাতার মধ্যে আছে সুগন্ধযুক্ত কটু তিক্তরস, রুচিকর গুনাগুন। যেটি সর্দি-কাশি , জ্বর, কৃমি ও বায়ুনাশক এবং অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া এটি ক্যান্সার নিরাময়ের ক্ষেত্রে অন্যতম ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাহলে এসো জেনে নেওয়া যাক তুলসী পাতার গুনাগুন ও উপকারিতা –
১. সর্দিকাশি :-
সর্দিকাশিতে তুলসী পাতার রস ভীষণভাবে কাজে লাগে। কাশি হলে একটু তুলসী পাতা ও আদার রস বানিয়ে তার মধ্যে একটু মধু মিশিয়ে সেটি খেলে কাশি কমে যায়। এটি গলা ব্যাথা, জমা সর্দি থেকেও উপকার পেতে সহায়তা করে।
২. জ্বর কমাতে সাহায্য করে :-
তুলসীর জীবাণুনাশক, ছত্রাক নাশক ও ব্যাকটেরিয়া নাশক ক্ষমতা আছে। তাই এটি জ্বর কমাতে সাহায্য করে। সাধারণ জ্বর থেকে ম্যালেরিয়া পর্যন্ত ভালো করতে পারে তুলসী পাতা। এক্ষেত্রে যা করতে হবে তা হল –
ক. আধা লিটার জলে কিছু তুলসী পাতা ও এলাচ গুঁড়ো দিয়ে ফুটিয়ে নিতে হবে। যাতে তুলসী ও এলাচ গুঁড়োর অনুপাত ১ : ০.৩ হারে থাকে। খ. কিছুক্ষণ জাল দেওয়ার পর মিশ্রণটিকে অর্ধেক করে নিতে হবে। গ. তারপর মিশ্রণটির সাথে চিনি ও দুধ মিশিয়ে ২-৩ ঘন্টা পর পর সেবন করতে হবে। এই মিশ্রণটি শিশুদের জন্য ভীষণ উপকারী।
৩. ডায়াবেটিস :-
ডায়াবেটিসের হাত থেকেও বাঁচাতে সাহায্য করে তুলসী পাতা। বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট থেকে দেখা গেছে , তুলসী পাতায় প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এসেনশিয়াল ওয়েল আছে যা ইউজেনল, মিথাইল ইউজেনল ও ক্যারিওফাইলিন উৎপন্ন করে। এই উপাদানগুলো অগ্নাশয়ের বিটা সেলকে কাজ করতে সাহায্য করে (বিটাসেল ইনসুলিন জমা রাখে ও নিঃসৃত করে)। যার ফলে ইনসুলিন এবং সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। যা রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ডায়াবেটিস ভালো হয়।
৪. ক্যান্সার নিরাময় :-
তুলসীতে আছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি কারসেনোজেনিক উপাদান যা ব্রেস্ট ক্যান্সার ও ওরাল ক্যান্সার এর বৃদ্ধিকে বন্ধ করতে পারে। কারণ এর উপাদানগুলো টিউমারের মধ্যে রক্ত চলাচল বন্ধ করতে পারে। তুলসী শুধু শরীরকে ক্যান্সার আক্রান্ত হবার থেকে বাঁচায় না , ক্যান্সার হলে সারিয়ে তুলতেও দারুণভাবে সাহায্য করে। তুলসীর মধ্যে যে ফাইটোক্যামিক্যাল রয়েছে তা লাং, লিভার, এবং স্কিন ক্যান্সার রোধে সাহায্য করে। এটি তুলসীতে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্টের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয় এবং ক্যান্সারকে ছড়িয়ে পড়তে দেয় না। যারা নিয়মিত তুলসী পাতার রস সেবন করেন তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সুযোগ অনেক কম।
৫. কিডনির পাথর দূর করতে সাহায্য করে :-
কিডনিকে ভালো রাখতেও তুলসী বেশ উপকারী। রক্তে ইউরিক এসিড এর লেভেলকে কমাতে সাহায্য করে কিডনিকে পরিষ্কার করে তুলসী পাতা। তুলসীর অ্যাসেটিক এসিড এবং এসেনশিয়াল ওয়েল এর উপাদানগুলো কিডনির পাথর কমাতে সাহায্য করে এবং সেই সঙ্গে ব্যাথাও কমায়। এই সমস্যার ক্ষেত্রে প্রতিদিন তুলসী পাতার রসের সঙ্গে একটু মধু মিশিয়ে খেতে হবে। এভাবে নিয়মিত ছয় মাস খেলে কিডনির পাথর দূর হবে।
জেনে রাখুন : আমলকি ও হরিতকির অসাধারণ উপকারিতা
৬. দাঁতের সমস্যা :-
তুলসী মুখের ভিতরে থাকা ব্যাক্টেরিয়াকে নির্মূল করে। যাদের দাঁতের অনেক সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে তুলসী পাতা অনেক উপকারী একটি জিনিস। দাঁতের সমস্যায় তুলসী পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে দাঁত মাজলে দাঁত ভালো থাকে। ফলে মুখে দুর্গন্ধের সমস্যা হয় না। এছাড়া সরিষার তেলের সাথে তুলসী পাতার গুঁড়ো মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে দাঁত মাজলেও দাঁত এবং মাড়ি শক্ত থাকে।
৭. মুখের ঘা দূর করতে :-
তুলসী পাতা মুখের আলসার ভালো করতে পারে। মুখের ঘা সারাতেও তুলসী পাতা ভালো কাজ করে। মুখের ইনফেক্শন দূর করতে তুলসী পাতা অতুলনীয়। প্রতিদিন কিছু পাতা (দিনে দুবার) নিয়মিত চিবোলে মুখের সংক্রমণ রোধ করা যেতে পারে।
৮. হার্টের অসুখ :-
তুলসী পাতায় আছে ভিটামিন সি ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এই উপাদানগুলো হার্টকে বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। তুলসীপাতা হার্টের কার্যক্ষমতা বাড়ায় ও এর স্বাস্থ্য ভালো রাখে ।
৯. ত্বকের সমস্যা দূর করে :-
তুলসী ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। ত্বকে চমক বাড়ানোর জন্য , এছাড়া ত্বকের বলিরেখা এবং ব্রণ দূর করার জন্য তুলসী , নিম , চন্দনের মিশ্রণ বানিয়ে ব্যবহার করলে উপকার হয়। তুলসীর পেস্ট স্কিনকে উজ্জ্বল, কোমল ও মসৃণ করতেও বেশ উপকারী।
১০. চোখের সমস্যা :-
চোখে অনেক সময় নানারকম ফাংগাল ইনফেক্শন হয়। তার ফলে চোখে অ্যালার্জি, লাল হয়ে যাওয়া , ফুলে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হয় । এগুলির হাত থেকে বাঁচায় তুলসী । এছাড়াও কম দৃষ্টিশক্তির সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে । এতে আছে অ্যান্টি ইউফ্লেমেটরি উপাদান, যা চোখকে ভালো রাখতে সাহায্য করে । রাতে কয়েকটি তুলসীপাতা জলে ভিজিয়ে রেখে ঐ জল দিয়ে সকালে চোখ ধুলে অনেক সমস্যা দূর হয়।
১১. মানসিক চাপ কমায় :-
মানসিক চাপে অ্যান্টিস্ট্রেস এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক অবসাদ প্রশমনে এমনকি প্রতিরোধে তুলসী চমৎকার কাজ করে। কোন সুস্থ ব্যক্তি যদি প্রতিদিন অন্তত ১২ টি তুলসীপাতা দিনে দুবার নিয়মিত চিবোতে পারেন তাহলে সে কখনো মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হবে না বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। কারণ তুলসীপাতা কর্টিসেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে মানসিক চাপ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।
১২. রোগ নিরাময় ক্ষমতা :-
তুলসীকে নার্ভের টনিক বলা হয় এবং এটি স্মরণশক্তি বাড়ানোর জন্য বেশ উপকারী। এটি শ্বাসনালী থেকে শ্লেষ্মা ঘটিত সমস্যা দূর করে। তুলসীপাতা পাকস্থলী ও কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
১৩. শিশু রোগ :-
তুলসীপাতার রস শিশুদের জন্য বেশ উপকারী। বিশেষত ঠান্ডা লাগা, জ্বর হওয়া, কাশি লাগা, ডায়রিয়া ও বমির জন্য তুলসীপাতার রস ভালো কাজ করে। জল বসন্তের পুঁজ শুকোতেও তুলসীপাতা ব্যবহৃত হয়।
১৪. চুল পড়া :-
তুলসীপাতার রস এবং আমলকী বেঁটে আধা ঘন্টা মাথায় রাখলে চুল পড়া বন্ধ হয়।
১৫. মাথাব্যাথা সাড়াতে :-
মাথা ব্যাথা ও শরীরের ব্যাথা কমাতে তুলসী খুবই উপকারী। এর বিশেষ উপাদান মাংসপেশীর খিঁচুনী রোধ করতে সহায়তা করে।
লেখাটি ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। আর এইধরনের লেখার আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে যুক্ত থাকো।