বেশির ভাগ মানুষই মনে করে থাকেন মানসিক প্রতিবন্ধকতা একটা অসুখ। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা কোনো অসুখ নয় , এটা অবস্থান। এই প্রতিবন্ধকতার শিকার যারা , তাদের বুদ্ধিমত্তা বয়স অনুপাতে বাড়ে না ,ফলে স্বাভাবিক সমবয়সী সব ছেলেমেয়েদের থেকে সর্বক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ে। কার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে ,কখন বা কোন পরিবেশে কী বলতে হবে সেটা তারা বুঝে উঠতে পারে না। তাদের নিজেদের একটা জগৎ তৈরী হয়। যার কিনারা খুঁজে পাওয়া মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে।
মানসিক প্রতিবন্ধীদের সংজ্ঞা বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে আমেরিকান এসোসিয়েশন অফ মেন্টাল রিটার্ডেশন (AAMR) যে সংজ্ঞাটি উপস্থাপন করেছে তা হল : বর্তমান অবস্থায় কাজকর্মে যথেষ্ট অক্ষম এবং সেই সঙ্গে স্বাভাবিকের তুলনায় বুদ্ধিবৃত্তি অতি অল্প। তা ছাড়া অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ,নিজের পরিচর্যা নিজে করা ,পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করা ,সামাজিক তৎপরতা ,নিজেকে সঠিকভাবে পরিচালনা ,স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, পড়াশুনা, অবসর বিনোদন ইত্যাদি আনুষঙ্গিক প্রতিযোজক আচরণেও সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধকতা লক্ষ করা যায় তারাই হল মানসিক প্রতিবন্ধী , এই অবস্থার নাম মানসিক প্রতিবন্ধকতা।
মানসিক প্রতিবন্ধিতার কারণ :-
৯০ থেকে ১১০ বুদ্ধ্যঙ্ক যাদের সেই মানুষদের স্বাভাবিক বুদ্ধ্যঙ্ক বলা হয়। যদি কারো বুদ্ধ্যঙ্ক ৯০ এর নীচে এবং ৭০ এর উপরে হয় তবে সেই মানুষকে প্রান্তিক অবস্থায় আছে বলে ধরা হয়। বুদ্ধ্যঙ্কের বিচারে এই সমস্ত শিশুদের একটু চেষ্টা করলে স্বাভাবিক শিক্ষা দেওয়া যায় ফলে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপনে পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে। যাদের বুদ্ধ্যঙ্ক ৭০ নীচে তাদেরই মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে ধরা হয়। মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই ৭০ -এর নীচে বুদ্ধ্যঙ্ক শিশুদের চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়।
১) বুদ্ধ্যঙ্ক ২০- ২৫ এর নীচে – অতি তীব্র প্রতিবন্ধকতা ( এই সমস্ত শিশুদের শিক্ষার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। জন্মাবস্থা থেকে এই শিশুদের জীবনে নেমে আসে অক্ষমতা এবং পরনির্ভরশীল জীবনযাপন ছাড়া কোনো উপায় থাকে না )
২) বুদ্ধ্যঙ্ক ২০- ২৫ থেকে ৩৫-৪০ – তীব্র প্রতিবন্ধকতা ( যে সমস্ত শিশু এই বুদ্ধ্যঙ্কের অধিকারী তাদের প্রাত্যহিক জীবনে কাজ চালানোর মত কিছু কৌশল শেখানো যাতে পরনির্ভরতার হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পায়। )
৩) বুদ্ধ্যঙ্ক ৩৫- ৪০ থেকে ৫০- ৫৫ – মধ্যম প্রতিবন্ধকতা ( এদের বলা হয় প্রশিক্ষণযোগ্য। এদের দৈনন্দিন জীবনের কাজ চালানোর শিক্ষার সঙ্গে কিছু সাধারণ বৃত্তিমূলক কাজ শেখানো যায়। )
৪) বুদ্ধ্যঙ্ক ৫০-৫৫ থেকে ৭০ – মৃদু প্রতিবন্ধকতা ( এদের শিক্ষণযোগ্য হিসেবে ধরা হয়। এরা সাধারণ ছেলেমেয়েদের মত শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ উপকৃত হয় না। এদের জন্য বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় )
ক। দৈহিক বৈশিষ্ট্য :- স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় মানসিক শিশুদের দৈহিক বিকাশ অত্যন্ত মন্থর গতিতে হয়। পেশি সমন্বয় ত্রূটিপূর্ণ এবং শ্লথ গতি দেখা যায়। অনেকের মধ্যে চোখ , নাক ,কান এবং বাচন ক্ষমতার ত্রূটি লক্ষ করা যায়।
খ। মানসিক বৈশিষ্ট্য :- এই শিশুদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তার অভাবই প্রধান বিষয়। চিন্তন ক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। কৌতূহল , যুক্তিক্ষমতা ,যথাযথ ভাষা প্রয়োগ , মনোযোগের অভাব , ধীর স্থির হয়ে বসার অভাব লক্ষ করা যায়।
গ। সামাজিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য :- সামাজিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করার ক্ষমতা না থাকায় এই শিশুদের সামাজিক বিকাশ তাদের বয়সের তুলনায় অনেক কম হয়। আর কোনটা নৈতিক ,কোনটা অনৈতিক, এই বিচার করার শক্তি তাদের থাকে না। বন্ধু নির্বাচনের বিচার করার শক্তি না থাকায় তারা মিশুক হতে পারে না।
এই শিশুদের দৈহিক বিকাশ মন্থর গতিতে হয়। শিশুদের বিকাশধারার প্রতি সেজন্য পিতা-মাতার লক্ষ রাখা উচিত এবং ত্রূটি নজরে এলে বিশেষজ্ঞ বা মনোবিদদের পরামর্শ নেওয়া উচিত যাতে অতি সহজেই তাদের চিহ্নিতকরণ করা যায়। শিশুদের চিহ্নিত করার কিছু উপায় নিম্নে আলোচনা করা হলো –
১. বুদ্ধি অভীক্ষা প্রয়োগ: – প্রমিত করা বুদ্ধি অভীক্ষা ভাষাযুক্ত বা ভাষাবিমুক্ত অভীক্ষা প্রয়োগ করে এই শিশুদের বুদ্ধ্যঙ্ক নির্ণয় করে সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে চিহ্নিতকরণ করা সম্ভব হয়।
২. সামাজিক পরিণমন অভিজ্ঞা প্রয়োগ :- অনেক সময় এই শিশুরা যথাযথ প্রশ্নের উত্তর ও নির্দেশ বুঝে উঠতে পারে না। তাই বুদ্ধি অভীক্ষা সব সময় সার্থক রূপ নিতে পারে না। তাই অভিভাবকদের মাধ্যমে তাদের পরিণমনের দিক নির্ণয় করে তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব হয়।
৩. ক্রমবিকাশ ইতিহাস সংগ্রহ করা :- এই ধরণের শিশুদের চিহ্নিত করার জন্য ক্রমবিকাশ ইতিহাস সংগ্রহ একটি অতি আবশ্যক অংশ। এই তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়।
ক। অতি তীব্র এবং তীব্র প্রতিবন্ধকতার শিকার সে সব শিশুরা তাদের জন্য শিক্ষা পরিকল্পনা :-
বিশেষ শিক্ষাপ্রণালী অতি তীব্র এবং তীব্র প্রতিবন্ধকতায় বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে না। কারণ তাদের বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠি এতই কম যে মোটামুটি শিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতা পরিমাণ না থাকারই সমান। তবুও যে শিশুরা এই অবস্থার শিকার তাদের সামগ্রিক অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য বিচার করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা পরিকল্পনা করা যায়।
প্রাক প্রাথমিক স্তর –
এই স্তরে এই শিশুদের সংবেদন সঞ্চালন উদ্দীপনা , শারীরিক বিকাশ , নিজের দৈনন্দিন কাজকর্মের প্রাথমিক অভ্যাস তৈরী করা ,পরিচিত ব্যক্তিকে চিনতে শেখা ইত্যাদি শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করা হয়।
বিদ্যালয়ের স্তর :-
শারীরিক গতিশীলতা , ভাষার বিকাশ – নাম শুনে ব্যক্তি ও বস্তুকে চিহ্নিত করা ,নিজের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা ইত্যাদি শিক্ষার চেষ্টা যাকে বিদ্যালয়ের স্তর বলা হয়।
প্রাপ্তবয়স্ক স্তর :-
প্রাপ্তবয়স্ক স্তরে আর একটু কঠিন সংবেদন সঞ্চালন সমন্বয় যেমন বাছাই করা , ভাঁজ করা , শারীরিক দক্ষতা ,নিজের যত্ন নেওয়া – নিজের কাজ নিজে করা , কথা বলার দক্ষতা – অন্যের কথা শোনা ,উত্তর দেওয়া ইত্যাদি।
খ ) মধ্যম মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা:-
এই ধরনের শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে সাধারণ দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়। এখানে যা শেখানো হয় সেগুলি হল – নিজের কাজ নিজে করা, ব্যক্তি ও সমাজ সম্পর্কিত ধারণা দেওয়া , শরীরশিক্ষা বিষয়ক ভাবনা প্রদান করা ,কাজ চালানোর মতো বিদ্যালয়ে শিক্ষা , অপরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া। এই বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দিয়ে এই শিশুদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সহজতম থেকে শুরু করে জটিলতা বা বৈচিত্র্য বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যাতে অন্যের সাহায্য ছাড়াই তারা নিজেরা নিজেদের কর্ম সম্পাদন করতে পারে।
গ ) মৃদু মানসিক প্রতিবন্ধী :-
এই ধরণের শিশুরা শিক্ষা গ্রহণে সক্ষম। কিন্তু তাদের শিক্ষা প্রথম থেকে সাধারণ বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে শুরু হলে তাদের অনেক অসুবিধায় পড়তে হয়। তাই প্রাক প্রাথমিক স্তরে এই শিশুদের শিক্ষার প্রস্তুতি পর্বে কিছু দক্ষতার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন। যেমন , ধীর ,স্থির হয়ে বসা , কোথায় ও কাজে মনোযোগ দেওয়া ,নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা ,শ্রবণ ও দর্শন উদ্দীপকের পার্থক্য করা , সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারা ,নিজের কাজ নিজে করা ,অন্যের সঙ্গে কথোপকথন করা ইত্যাদি।
সারা বিশ্বে প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষের প্রতি অত্যন্ত মানবিক ও সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করা হয়ে থাকে । কিন্তু আমাদের দেশে অন্য সমস্ত প্রতিবন্ধী শিশুদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য যতরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে , মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ততটা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি । অনেকেই মনে করেন এই সমস্ত শিশুদের সাধারণ বিদ্যালয়ে সকলের সঙ্গে শিক্ষাদানের চেয়ে বিশেষ বিশেষ উপায়ে আলাদা শিক্ষাদান বেশি কার্যকর । যাই হোক না কেন , বহির্বিশ্বের অনেক দেশেই সাধারণ ভাবে মূল স্রোতে সবার সঙ্গে শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে অনেক সাফল্য লাভ করেছে। সেখানে আমাদের দেশ কিছুটা দেরিতে হলেও সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছে একথা সত্য। সর্বোপরি একথা বলা প্রয়োজন যে , সমাজের মূল স্রোত থেকে সরিয়ে না রেখে , প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক শিক্ষিকা দ্বারা অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে , আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে এবং এইসমস্ত শিক্ষার্থীর ক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক । কেন না , কাউকে বাদ দিয়ে সমাজ গড়া যায় না । কবির ভাষায় —
” যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে ,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে ।”
কেননা আলাদা আলাদা ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের সম্মিলিত পৃথিবীই
সুন্দর হয়ে ওঠে প্রেম ভালোবাসার অকৃত্রিম বন্ধনে । “
এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটি ফলো করুন।