কোথায় এবং কেন চুপ থাকা প্রয়োজন ? চুপ থাকার উপকারিতা গুলি কী কী ?
” Wise men speak because they have something to say; Fools because they have to say something.“ ~ Plato
চুপ থাকার উপকারিতা
অনেকেই বলে যে কথার ওপরেই জগৎ চলে। এই কথা দু’ধরনের হয় একটি হলো শাব্দিক আরেকটি হল নীরব। শাব্দিক কথা আমরা শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করি আর নীরব কথা আমরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করে আমরা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের(মন)দ্বারা উপলব্ধি করি। কাজেই নীরবতাও একটি ভাষা। ছবি, শিল্প,লেখ্য সাহিত্য ইত্যাদি আসলে নীরব ভাষাই। কাজেই যে কোন ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে কথা বলা বা শাব্দিক ভাষা প্রয়োগ অনেকগুলি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। মুখ থেকে যে বাণী একবার নিঃসৃত হয়ে যায়, তা আর ফেরানো সম্ভব হয় না। তাই কখনো কখনো কথা বলা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, কথা না বলাটা তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাহলে আজ আমরা জেনে নেই কোথায় চুপ থাকতে হবে এবং কেন চুপ থাকতে হবে , এবং চুপ থাকার সাতটি উপকারিতা সম্বন্ধে ।
কোথায় চুপ থাকতে হবে এবং কেন চুপ থাকতে হবে :-
১.যখন কেউ তার সমস্যার কথা বলে :- যখন কেউ তার সমস্যার কথা আমাদের বলে, কিংবা তার ভেতরে চলতে থাকা ইমোশনগুলো শেয়ার করে সেই সময় অতি শীঘ্রই রায় না দিয়ে,ঠিক ভুল বিচার না করে তার কথা গুলো চুপ করে মন দিয়ে শুনতে হয়। এই মুহুর্তগুলিতে চুপ থাকাই সামনের জনের জন্য সেরা চিকিৎসা।
২.অর্থহীন বিতর্কিত আলোচনা :- যে কোনো বিতর্কিত আলোচনা থেকে সমস্যার সৃষ্টি হয়। একমাত্র বিতর্কিত প্রতিযোগিতা বা কোনো বিতর্কের সমাধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত না হলে বিতর্কে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সেক্ষেত্রে চুপ থাকাই শ্রেয়।
৩.সম্পর্ক উন্নতি করতে :- ভালোবাসার মানুষ তার প্রিয়জনকে কিছু বলতে চায় সেক্ষেত্রে এক সঙ্গে কথা না বলে চুপ করে শুনলে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। কেননা খোলাখুলি আলোচনা করতে গিয়ে ব্যবহৃত কোনো কোনো কথাকে ধরেই নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তাই সম্পর্কের মধ্যে আলোচনা চলাকালীন বিতর্কের সম্ভাবনা ঘটলে তর্ক করার চেয়ে, চুপ থাকা প্রয়োজন। আগে তার কথাগুলো পুরোটা মন দিয়ে শোনা প্রয়োজন এবং পরে বলবার হলে সেটা বুঝিয়ে বলা উচিত। প্রাক্তন সিনেমার একটি গানের লাইন মনে পড়ে যায় ‘কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়।’ এই ক্ষেত্রে একজন চুপ থাকলে সম্পর্ক গাঢ় হয়।
৪. অপরিচিত স্থানে :- বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা অফিস, দোকান, বাজার ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা মানুষের সংস্পর্শে আসি। সে ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে – এরকম মানুষের দেখা পাওয়া যায় হামেশাই ; এরকম অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই আছে । এ সমস্ত ক্ষেত্রে সময় যেমন নষ্ট হয়, তেমনি অনাহুত ঝামেলা ঘাড়ে চাপার সম্ভাবনা থাকে তাই বুদ্ধিমান মানুষ অপ্রয়োজনে কথা না বলে চুপ থাকেন।
৫. অপ্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে :- বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা আড্ডায় নানা প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় উঠে আসে। বুদ্ধিমান মানুষ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেও অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি মুচকি হেসে এড়িয়ে যান। এতে মেধা পরিশ্রম যেমন বাচে তেমনি উন্নত পার্সোনালিটি প্রকাশ পায়।
৬.গভীর অধ্যয়নের সময় :- গভীর অধ্যয়ন বলতে কোন একটা বিষয় নিয়ে পড়ালেখা, ভাবা ও তথ্য সংগ্রহ বোঝায়।তাই অধ্যয়নের প্রক্রিয়াটি মনের ভেতর স্নান খাওয়া ভ্রমণ সবসময় চলতে থাকে । এরকম গভীর অধ্যয়ন চলাকালীন অন্য বিষয় আলোচনায় অধ্যয়নের মনোযোগ ব্যাহত হতে পারে তাই বিজ্ঞানী লেখক প্রমুখরা চুপ থাকেন।
৭. প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে :- প্রতিবাদ করা ভাল। তবে পরিস্থিতি বিচার করে। যদি দেখেন কোনও স্থানে আপনাকে অপমানিত হতে হচ্ছে, অথচ আপনার প্রতিবাদ করার মতো পরিস্থিতি নেই। চুপ করে যাবেন। মনে রাখবেন, যুদ্ধে পিছিয়ে আসা মানেই হার নয়। সেটা কৌশল সাজাবার পরিকল্পনাও হতে পারে।
আরও পড়ুন : ৭টি অভ্যাস যেগুলি মানুষের অপছন্দের কারণ
৮. এছাড়াও আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে আমাদের চুপ থাকা প্রয়োজন :-
ক। গাড়ি চালানোর সময়
খ। শরীরচর্চার সময়
গ। খাবার সময়
গাড়ি চালানোর সময় আর খাবার সময় কেন চুপ থাকতে হয় সকলেই জানেন । শরীর চর্চার সময় অতিরিক্ত এনার্জি ও অতিরিক্ত অক্সিজেন খরচ হয় । হাঁপাতে হাঁপাতে কথা বললে আরো অতিরিক্ত এনার্জি ও অক্সিজেন এর প্রয়োজন হবে । সেক্ষত্রে ফুসফুস ও হার্ট বিপন্ন হবার সম্ভাবনা থাকে । কাজেই এই কাজগুলো নীরবে করা প্রয়োজন ।
চুপ থাকার উপকারিতা গুলি কী কী ?
১.মন ও মস্তিষ্ক শান্ত হয় :- আমাদের এই অশান্ত পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষের মনই অশান্ত, মনের ভেতর সর্বদা চলতে থাকে দ্বন্দ্ব আর উথাল পাতাল করা অশান্তি। তাই কিছুটা সময় সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিঃশব্দে আর নিজের সঙ্গে যদি নিস্তরঙ্গ, শান্ত সময় কাটানো যায়,তবে মন নামক সরোবরের জল শান্ত, স্বচ্ছ ,কাঁচের মত হয়ে যায়। অন্তরে শান্তি ফিরে এলে মন ও মস্তিষ্ক শান্ত হয় এবং শরীরও ভালো থাকে। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে চেঞ্জে যাবার পরামর্শের বিষয়টি প্রচলিত।
২.মস্তিষ্কে নতুন কোষ জন্মায় :- একাধিক গবেষণায় একথা প্রমাণিত হয়েছে প্রতিদিন যদি নিয়ম করে কয়েক মিনিট চুপ থাকা যায় তা গান শোনার থেকেও বেশি স্বস্তি দেয় মানুষের মস্তিষ্ককে। এতে ব্রেন নিজের একাধিক ক্ষতকে সারিয়ে তোলার সুযোগ পায়। এবং নতুন কোষের জন্ম হয় মস্তিষ্কের হিপোকম্পাসে, ফলে আমাদের নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা বেড়ে যায় ও স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটে।
৩.জ্ঞানের বিকাশে সহায়তা করে :- কয়েক মিনিটের নীরবতা মানব শরীরে জ্ঞানের বিকাশে সহায়তা করে। ফলে ভাষার দক্ষতা বেড়ে যায়। সারাদিনের ঘটনাগুলো এলোমেলোভাবে মস্তিষ্কে জমা হয় । চুপ থাকার ফলে সেগুলো স্তরে স্তরে সাজাবার সুযোগ ঘটে । আর তখুনি অন্তরদৃষ্টি দ্বারা জ্ঞানলাভ ঘটে ।
৪. মনসংযোগ বাড়ায় :- মনঃসংযোগ বাড়াতে কয়েক মিনিটি চুপ থাকাকে বা নিঃশব্দতাকে সঙ্গী করুন। প্রাণায়াম বা যোগব্যায়ামের মাধ্যমে আপনি কয়েক মিনিট চুপ থাকার অনুশীলন করতে পারেন এতে করে মনোসংযোগ যেমন বাড়বে তেমন বাড়বে আপনার কর্মক্ষমতা।
৫.স্ট্রেস লেবেল কমায় :- যখন দেখবেন আপনার স্ট্রেস লেভেল বাড়ছে, তখনই একটা নিস্তব্ধ জায়গায় চলে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে বড় বড় শ্বাস নেবেন। এমনটা করলে দেখবেন অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক চাপ দূরে পালাবে। প্রসঙ্গত, মাত্রাতিরিক্ত শব্দ মস্তিষ্ককে বিচলিত করে তোলে। ফলে সারা শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। অপরদিকে নিঃশব্দতা ব্রেণকে শান্তি প্রদান করে, যা স্ট্রেস লেভেল দূর করার জন্য ভীষণ উপকারী।
৬. সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায় :- চুপ থাকার ফলে মনের শান্ত অবস্থায় মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় সঠিকভাবে কাজ করার সুযোগ পায়। লেখক , কবি , চিত্রশিল্পী , কিংবা যে কোনো সৃজনশীল শিল্পীরা চুপ করে ভেবে তাদের শিল্পকে বুঝে নেন । তাই শিশুদেরকেও প্রতিদিন কিছুটা সময় চুপ থাকতে শেখালে তাদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায় ।
৭. অনিদ্রার সমস্যা দূর করে :- মানুষের অনিদ্রার কারণ অতিরিক্ত চাপ । শরীর ও মনের উপর যে চাপ জমতে থাকে তাতে মানুষের ব্রেইন নিরন্তর উদ্দীপ্ত ও উদগ্রীব হয়ে পড়ে । আর এতেই অনেকের অনিদ্রার সমস্যা দেখা দেয় । তাই রোজ নিয়ম করে অন্তত দু’ঘন্টা চুপ থাকলে অনিদ্রার সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় বলে আধুনিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
চুপ থাকার উপকারিতা নিয়ে আমাদের লেখাটি ভালো লেগে থাকলে কমেন্ট বক্সে আমাদের জানান। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে যুক্ত থাকুন।