শিক্ষা ও জীবন

ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ইদ্ ,ইগো ও সুপার ইগো কী ?

4 Minute Read

সিগমুন্ড ফ্রয়েড (মে ৬,১৮৫৬-সেপ্টেম্বর ২৩,১৯৩৯) ছিলেন একজন অস্ট্রিয় মানসিক রোগ চিকিৎসক এবং মনস্তাত্ত্বিক। তিনি মনঃসমীক্ষণ (Psychoanalysis) নামক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবক। ফ্রয়েড “মনোবীক্ষণের জনক” হিসেবে পরিগণিত। যেসব ব্যক্তি তাদের তত্ত্ব দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন ফ্রয়েড তাদের মধ্যে অন্যতম। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব।

ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব :-

মানুষের মন প্রচন্ডভাবে গতিশীল এবং এই মন নামক মানবিক উপাদানটি সহজাত প্ৰবৃত্তির তাড়না,বিরোধ, গূঢ়ৈষা,অবদমন ইত্যাদির মতো কিছু ইচ্ছামূলক ক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মনোবিদ্যায় সচেতন মনের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি অবচেতন মনের ক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনারও বিস্তৃতি হয়েছে। অবচেতন মনের অস্তিত্বে বিশ্বাসী মনোবিদরা মানুষের সমস্ত আচরণের নির্ধারক হিসেবে অবচেতন মনকে বিবেচনা করছেন। মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের ফলে মনবিদ্যার এক বিশেষ শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যাকে বর্তমানে বলা হয় মনঃসমীক্ষণবাদ। এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ফ্রয়েডের নাম উল্লেখ করা যায়। মানুষের আচরনের প্রকৃত স্বরূপ বিশ্লেষণে মনোবিদ্যার এই শাখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ফ্রয়েডের মতে আমাদের মনোজগতে যত ভাব,অনুভূতি, আবেগ ইত্যাদি আছে, তা তিনটি শ্রেণিভুক্ত। ফ্রয়েডের পূর্ব পর্যন্ত মনের অন্যান্য অংশের ক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞানসম্মত ধারণা ছিল না। তিনি বলেছেন তিনটি স্তর আছে-


ক.চেতন(Conscious),
খ. অবচেতন( Subconscious)বা প্রাকচেতন (pre-conscious) এবং
গ. অচেতন(Un-conscious)।

ক. চেতন মন (Conscious Mind) :-

মনের যে অংশের সঙ্গে বাস্তব জগতের সম্পর্ক বর্তমান বা মনের যে অংশের বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা সচেতন, তাকেই তিনি বলেছেন চেতন মন(Conscious Mind)। যখন আমরা কোনো কাজ করি বা কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করি,কোনো কিছু উপলব্ধি করি,কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি তখন আমাদের মনের এ অংশ কাজ করে থাকে।

খ. অবচেতন মন ( Subconscious Mind) :-

এটি মনের সবচেয়ে বৃহত্তর অংশ। অবচেতন মনে অবস্থিত বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও অবচেতন মনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই থাকে না। এক কথায় আমাদের অবচেতন মনের দরজা হলো আমাদের সচেতন মন;যার মাধ্যমে আমাদের অর্জিত স্মৃতি,অভিজ্ঞতা আমাদের অবচেতন মনে সংরক্ষিত হতে শুরু করে। এই অবচেতন মনই কিন্তু মানুষের ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করে থাকে। চেতন মনের সাথে অবচেতন মনের পার্থক্য হল চেতন মনকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও অবচেতন মনকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। অবচেতন মন- ই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ফ্রয়েডের মতে, মানব মনের প্রায় ৯০ শতাংশই অবচেতন বাকী কেবল ১০ শতাংশ চেতন অবস্থায় থাকে।

গ. অচেতন মন (Un-conscious Mind) :-

মনের যে অংশটি আমাদের জাগ্রত চেতনার আড়ালে অথবা সরাসরি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাকে অচেতন মন বলা হয়।অচেতন মন আমাদের জৈবিক প্রয়োজনগুলি যেমন ক্ষুধা, পিপাসা,যৌনতা ইত্যাদির বার্তা আমাদের চেতন মন থেকে সংগ্রহ করে । আবার , মানুষ সচেতন অবস্থায় যেসব চিন্তা, ভাবনা , অনুভূতি উপলব্ধি করে সেই সবকিছু প্রাক-চেতন মনের স্তর পেরিয়ে অচেতন মনে সঞ্চিত হয়।

ফ্রয়েড তাঁর এই ক্ষেত্রগত শ্রেণি বিভাগের সঙ্গে সমতা রেখে মনের ক্রিয়াগত দিককেও(Dynamic aspect)তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। তিনি বলেছেন মানুষের মন তিনটি স্তরে কাজ করে। এই বিভাজন অগ্রসর হয় ১৯২৩ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত “The Ego and The Id” নামক বইয়ের সহায়তায়। এই তিনটি স্তর হল – অদস্ (Id), অহম্ (Ego) এবং অধিসত্তা (Supar Ego)

অদস্ (Id) :-

ইদ্ হল পূর্ণমাত্রায় অচেতন। তবে সবচেয়ে মৌলিক। এটি লিবিডোর আদিম আশ্রয়স্থল এবং ব্যক্তির সমস্ত প্রবৃত্তিমূলক কামনার পেছনে শক্তি জুগিয়ে থাকে। এর কাজই হল মানুষের সমস্ত রকম প্রবৃত্তির চাহিদা পরিতৃপ্ত করা। এই চাহিদা দুইভাবে ব্যক্তি জীবনে আসে। প্রথমত, ব্যক্তি জন্মগতভাবে কিছু প্রবণতা নিয়ে আসে। এই জন্মগত প্রবণতাগুলির উৎস অদস্ বা ইদ্। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি-জীবনে নানা রকম চাহিদার সৃষ্টি হয়। সামাজিক নানা বিধি-নিষেধ থাকার, জন্য বা ব্যক্তিগত অক্ষমতার জন্য আমরা সবসময় এগুলিকে চরিতার্থ করতে পারি না। এমত অবস্থায় আমরা এইসব আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদাগুলিকে আমাদের অবচেতন মনে অবদমন করি। এই অবদমিত চাহিদা ও জন্মগত চাহিদাগুলি অবচেতন মনে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে না। তাদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে কম্প্লেক্স বা জট (Complex) তৈরি করে এবং গতির ফলে তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এই গতিধর্মিতার(dynamic nature) দরুন এইসব চাহিদাগুলি সবসময় পরিতৃপ্তি পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এইজন্য ফ্রয়েড বলেছেন ইদ্, সবসময় সুখভোগের নীতি (pleasure principle)অনুসরণ করে। ইদ্, হচ্ছে মানুষের নগ্ন কামনা-বাসনার প্রতিচ্ছবি। এখানে পশু ও মানুষ স্বভাবগতভাবে এক । ভালো মন্দ বিচারের কোন অবকাশ তার নেই। সবসময় চায় মনের অতৃপ্ত বাসনা চরিতার্থ করতে। আর সুখই তার কাছে প্রধান। কিন্তু ইদ্-এর বিভিন্ন কামনাকে চরিতার্থ করার জন্য বাইরের জগতের সঙ্গে বোঝাপড়া করা প্রয়োজন। হয় বহির্জগতের বশ্যতা স্বীকার করতে হয় অথবা তাঁকে জয় করতে হয়। কিন্তু ইদ্(Id) -এর মত অন্ধ অবচেতন শক্তির দ্বারা এই কাজ করা সম্ভব হয় না এই কাজের জন্য ব্যক্তি মনের উচ্চতম স্তর আছে।

অহম্ (Ego) :-

দ্বিতীয় স্তরকে ফ্রয়েড বলেছেন অহম্(Ego)। ইদ্ তার কোন ইচ্ছাই সরাসরি পূরণ করতে পারে না তার ইচ্ছা বাস্তবে চরিতার্থ করতে হলে অহম্(Ego) এর প্রয়োজন। জন্মের সময় অহম্ থাকে অতি দুর্বল। কিন্তু শিশু যত বড় হয় ততই বাস্তবের সংস্পর্শে এসে অহম্(Ego) পুষ্ট হতে থাকে। ইদ্ অনুসরণ করে সুখভোগের নীতি কিন্তু অহম্(Ego) পরিচালিত হয় বাস্তব নীতির দ্বারা(Reality Principle)। অহম্ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন এবং যুক্তিধর্মী। সে ভালোভাবেই বোঝে যে তাকে সমাজে অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে হবে। অর্থাৎ অহম্ বহির্জগতের বাধাকে স্বীকার করে এবং কোনো প্রতিক্রিয়া করলে যদি সে বোঝে যে ইদ্-এর কোন বিশেষ চাহিদা পরিতৃপ্ত হবে অথবা ব্যক্তি সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে না, সেই কাজ সে করতে দেয়। অন্যথা সে ইদ্-এর ইচ্ছাকে চেপে রাখে বাইরে প্রকাশ হতে দেয় না। বস্তুতঃ ইদ্-এর তৃপ্তি মানে অহমের নিজেরই তৃপ্তি কিন্তু বাস্তবের চাপে অহম্ ইদ্- কে দাবিয়ে রাখে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে অহমকে(Ego) প্রহরী বলা যেতে পারে। কেন না এই ইগো-ই ঠিক করে দেয় মানুষটির ব্যক্তিত্ব কেমন অর্থাৎ কতটা সামাজিক বা কতটা আত্মপর ।

অধিসত্তা (Supar Ego) :-

ব্যক্তির অতি শৈশবেই সুপার ইগো জন্ম হয়। আসলে এটি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বলে নীতিবোধ ও বিধি নিষেধের ধারণা এবং কিছুটা মাতা পিতার কাছ থেকে অর্জন করার নৈতিক শিক্ষা এই দুয়ে মিলে তৈরি হয়েছে। নিজের মনের দাবি ও বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চেয়ে অহমকে অনেক সময় কিছুটা সমঝোতা করে চলতে হয় । কখনো কখনো হয়তো কিছুটা অন্যায় কাজকে প্রশ্রয় দিতে হয়। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যই এটা প্রয়োজন। সেই জন্য অহমের ওপর নজরদারি করার জন্য একটি সত্তা আছে যার নাম ফ্রয়েড দিয়েছেন সুপার ইগো। সুপার ইগোর দুটি অংশ। একটি হলো আমাদের উচিত-অনুচিত বোধ(Ego ideal)। অপরটি হলো আমাদের, ন্যায়- অন্যায়ের সতর্কত প্রহরী বিবেক(Conscience) । অর্থাৎ দৈবাৎ কোন অন্যায় করলে আমরা যে অপরাধবোধে ভুগি তা বিবেকের দেওয়ার শাস্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু বাস্তব জীবনের সমঝোতা ছাড়া বাঁচা যায় না। সুপার ইগো অস্বাভাবিক শক্তিশালী হলে সব কিছুকে উচিত-অনুচিত এইভাবে বিচার করতে চেয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা দুরূহ হয়ে ওঠে। সুতরাং অহম্-এর আরেকটি কাজ হল সুপার ইগোর সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করা।

এইভাবে সিগমুন্ড ফ্রয়েড খুব সুন্দরভাবে আমাদের মনের গঠন ও ক্রিয়াকলাপের ব্যাখ্যা করেছেন । তাই ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব শিক্ষা বিজ্ঞানে এতটা গুরুত্বপূর্ণ । তাহলে বন্ধুরা, আশা করি আজ আমরা সুন্দর একটা বিষয়ের উপর ধারণা পেলাম । আমাদের ফেজবুক পেজটি কিন্তু লাইক করে সঙ্গে থাকবেন । আর ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন । পরের আর্টিকেল নিয়ে আসছি আবার, কথা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *