বিখ্যাত ব্যক্তিত্ত্ব

ভারতীয় বক্সার মেরি কম। জন্ম, শিক্ষা, খেলাধুলা, পরিবার, পুরস্কার

4 Minute Read

Don’t give up as there is always a next time.” – Mary kom

নারীশক্তি যখন গর্বের বিষয় হয়, তখন সেই শক্তিতে দেশ জাতির সৌভাগ্য সূচিত হয়। ভারতীয় বক্সিং এর দুনিয়ায় এমনই একজন নারী হলেন বক্সিং কুইন মেরি কম। তিনি একমাত্র মহিলা বক্সার যিনি পাঁচ বারের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন এবং ছয়টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেই পদক বিজেতা । তাঁর পুরো নাম মাংতে চুংনেইজাং মেরি কম। তিনিই একমাত্র ভারতীয় মহিলা বক্সার যিনি ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকসে ৫১ কেজি ফ্লাইওয়েট বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ লাভ করেন। এই অলিম্পিকসে তিনি একটি ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। তিনি ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিয়নে এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জেতা প্রথম ভারতীয় মহিলা বক্সার হয়েছিলেন। এবং ২০১৮ কমনওয়েলথ গেমসে সোনার জয়ী প্রথম ভারতীয় মহিলা বক্সার। সম্প্রতি ছয়বারের এআইবিএ মহিলা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং পাঁচবারের এএসবিসি এশিয়ান মহিলা চ্যাম্পিয়ন মেরি কম এশিয়ান মহিলা বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে দুবাইয়ের (2021 ASBC Asian Boxing Championships in Dubai)
ফ্লাইওয়েটে (৫১ কেজি) প্রতিযোগিতা করে মেরি কম ২-৩ হারলেন দু’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন  কাজাখস্তানের নাজিম কাইজাইবের কাছে। এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে মেরি কমকে। তবে ৩৮ বছর বয়সেও লড়াকু মেরি কম কিন্তু হাল ছাড়েন নি শেষ পর্যন্ত লড়াই লড়ে গেছেন। আজ জানবো বক্সিং কুইন মেরি কমের জীবনী, কৃতিত্ব সম্পর্কে-

জন্মস্থান :-

মেরি কম (১ মার্চ ১৯৮৩) জন্মগ্রহণ করেন উত্তর ভারতের গ্রামীণ মণিপুরের চুরচাঁদপুর জেলার মৈরাং লামখাই, কঙ্গাথী গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। তাঁর পিতা মাংতে টোনপা কম (কৃষক, প্রাক্তন রেসলার)। মা – মাংতে আখম কম।

শিক্ষা :-

বক্সিংয়ের প্রতি তাঁর অত্যাধিক ভালোবাসা এবং সেটি ভালোভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালীন পড়াশুনা ছেড়ে দেন। পরে, তিনি অবশ্য পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেন এবং স্নাতক সম্পন্ন করেন।

মেরি কমের পারিবারিক জীবন:-

কমের সাথে ফুটবলার লড়াকু মনের অধিকারী করুং ওনখোলার (অন্লার) বিয়ে । ২০০০ সালে বেঙ্গালুরু ট্রেনে ভ্রমণের সময় তাঁর লাগেজ চুরি যায় । সেই সূত্রেই তাদের প্রথম আলাপ হয়। পাঞ্জাবের জাতীয় গেমসে যাওয়ার পথে নয়াদিল্লিতে তিনি ওনখোলার সঙ্গে আবার দেখা করেন , যিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছিলেন। ওনখোলার ছিলেন উত্তর-পূর্ব ছাত্র সংস্থার সভাপতি এবং কমকে নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন। এরপর তারা বন্ধু হয়ে ওঠেন এবং একে অপরের সঙ্গে দেখা করে চার বছর পর ২০০৫ সালে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
তাদের তিনটি পুত্রসন্তান ও একটি কন্যা সন্তান রয়েছে । তারা ২০০৭ সালে যমজ সন্তানলাভ করেন এবং ২০১৩ সালে পরবর্তী পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন । ২০১৮ সালে কম এবং তার স্বামী মেরিলিন নামের একটি মেয়েকে দত্তক নেন । মাতৃত্ব কখনোই তাঁর কেরিয়ারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। প্রথমবার তিনি যমজ সন্তানের মা হওয়ার পরেও বক্সিং চালিয়ে যান।

খেলাধুলা :-

মেরি কম নিরন্তর দারিদ্রের সাথে লড়াই করে বড় হয়েছে। শৈশবে তিনি তাঁর পিতামাতাকে চাষের কাজে সাহায্য করতেন, স্কুলে যেতেন এবং প্রাথমিকভাবে অ্যাথলেটিক্স শিখেছেন এবং পরে বক্সিং। স্বর্ণপদক প্রাপ্ত ভারতীয় বক্সার ডিঙ্গকো সিংয়ের সাফল্যতা তাঁকে বক্সিং-এর প্রতি অনুপ্রাণিত করেছিল। সম্প্রতি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪২ বছর বয়সেই তিনি প্রয়াত হলেন। শুরুর দিকে তাঁর পরিবার তাঁর বক্সিং-কে মেনে নেননি। তাঁর প্রিয় খেলা ভলিবল,ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স,রেসলিং।

কোচিং :-

মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের এক জিমে কোচিং নিতেন। তাঁর প্রথম কোচের নাম-কে কোসানা মেটেই। তিনি
বলছিলেন, ‘মনে আছে ও আসত একটা ছেঁড়া ট্র্যাকসুট পরে – কিন্তু ওই বয়সেই ছোট্ট মেয়েটার ইচ্ছাশক্তি ছিল সাঙ্ঘাতিক।’

বক্সিং এ চ্যাম্পিয়ানশিপ অর্জন :-

মেরি কম মাত্র ১৮বছর বয়সে, ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড অ্যামেচার বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে (USA ) রৌপ্য পদক অর্জন করেছিলেন।তিনি হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা বক্সার যিনি ২০১২ সালে AIBA চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করার পর ২০১২ সালে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন। এবং তিনি AIBA ওয়ার্ল্ড উইমেন’স র‌্যাঙ্কিং ফ্লাইওয়েট ক্যাটাগরিতে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছেন। বক্সিং-এ তাঁর দুর্দান্ত অবদানের কারণে, আন্তর্জাতিক অ্যামেচার বক্সিং অ্যাসোশিয়েশন তাঁর নাম রেখেছিল ‘ম্যাগনিফিকেন্ট মেরি’। প্রথমবার কোনও ক্রীড়াবিদকে একটি বিখ্যাত ক্রীড়া সংস্থা ডাকনাম দিয়েছিল। ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর, নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ১০ তম এআইবিএ মহিলা ওয়ার্ল্ড বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে তিনি ৬ টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ সোনা জয়ী বিশ্বের প্রথম মহিলার শিরোপা অর্জন করেন।

টুর্নামেন্টের ২০১৯ সংস্করণের আগে মেরি কম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সাতটি পদক জিতেছে। ২০০১ সালে ৪৮ কেজি বিভাগে তার প্রথম পদক রৌপ্য ছিল। ২০০২ সংস্করণে তিনি স্বর্ণ পদক অর্জন করেছিলেন। ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে মেরি কম আবারও স্বর্ণপদক অর্জন করেন এবং তারপরে ২০০৮, ২০১০ এবং ২০১৮ সালে তার তালিকায় আরও যোগ করেন। তার ৮ ম বিশ্ব পদকটি অর্জন করে মেরি কম টুর্নামেন্টে এবং আয়ারল্যান্ডের সাতটি পদক প্রাপ্ত কিউবার ফেলিক্স সাভনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন এবং কেটি টেইলর, যার কেরিয়ারে ৬টি বিশ্ব মেডেল ছিল।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন:-

Mary Kom Awards

মেরি কম
Source : Wikipedia

ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন (এআইবিএ) মেরি কমকে ” আশাপ্রদ বক্সিং ক্যারিয়ার” এর জন্য প্রথম এআইবিএ কিংবদন্তি পুরষ্কার প্রদান করে।

ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন (এআইবিএ) মেরি কমকে ২০১৬ এআইবিএ উইমেনস ওয়ার্ল্ড বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসাবে ঘোষণা করেছে।

পদ্ম বিভূষণ (ক্রীড়া), ২০২০

পদ্মভূষণ (ক্রীড়া), ২০১৩

রাজীব গান্ধী খেলা রত্ন পুরষ্কার, ২০০৯

পদ্মশ্রী (ক্রীড়া), ২০০৬

অর্জুন পুরষ্কার (বক্সিং), ২০০৩

পিপল অফ দ্য ইয়ার- লিমকা বুক অফ রেকর্ডস, ২০০৭

‘ম্যাগনিফিকেন্ট মেরি’, এআইবিএ ২০০৮

মহিলাদের বক্সিংয়ের জন্য আন্তর্জাতিক বক্সিং সমিতির রাষ্ট্রদূত ২০০৯

২০১০ সালের ক্রীড়াবিদ, সাহারা স্পোর্টস অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও আরও অন্যান্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি।

মেরি কম বক্সিং একাডেমি :-

বক্সিং ম্যাচে লড়ে নিজের অর্জিত অর্থ দিয়ে মেরি কম ২০০৭ সাল থেকে তাঁর নিজের শহরে তিনি আগামী দিনের বক্সারদের জন্য গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব অ্যাকাডেমি। যেখানে তিনি ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে বক্সিং প্রশিক্ষণ দেন। তারা নিখরচায় থাকতে পারে মেরির নিজের বাড়িতেই। অ্যাকাডেমির দৈনন্দিন রুটিনটা অবশ্য খুব কঠিন – প্রতিটা বাচ্চাকে ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে পড়তে হয়, রোজ স্কুলে যাওয়ার আগে করতে হয় বেশ কয়েক ঘন্টার প্র্যাকটিস।মেরি সব সময়ই বিশ্বাস করে এসেছে খেলাধুলোই হল দারিদ্র থেকে মুক্তির পথ, আর রাজ্যের তরুণদের কাছে এই বার্তাটাই তিনি সব সময় পৌঁছে দিতে চেয়েছেন।

আত্মজীবনী :-

মেরি কমকে নিয়ে লেখা আত্মজীবনী : Unbreakable : An Autobiography, Book by Dina Serto & Mary Kom.

মেরি কমের জীবনী নিয়ে সিনেমা :-

মেরি কমের জীবন সংগ্রাম , কঠোর লড়াইকে শিল্পজগতও সম্মান দিতে চেয়েছে। তাই ২০১৪ সালে মুক্তি পায় তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি বায়োপিক ছবি ‘মেরি কম’। যাতে মেরি কমের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া।

মেরি কম কে নিয়ে আমাদের লেখাটি কেমন লাগলো তা অবশ্যই কমেন্টে আমাদের জানাও। ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটি ফল করো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *