শরীর ও স্বাস্থ্য

মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা । Fenugreek (Methi) benefits & side effects

4 Minute Read

মেথি কী ?

মেথি একটি বর্ষজীবী গাছ। মেথির বৈজ্ঞানিক নাম ”Trigonella foeunum-graecum”। মেথির বৈজ্ঞানিক প্রতিশব্দ ” Fenugreek”। মেথি মৌসুমি গাছ হিসেবে পরিচিত। মেথি শাক গ্রাম বাংলায় শাক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একাধিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, দূষিত পরিবেশ এবং ভেজাল খাবারের রাজ্যে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে মেথির ভূমিকা অনস্বীকার্য। রান্নাঘরে মসলা হিসেবও মেথির ব্যবহার প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসছে। এছাড়াও যুগ যুগ ধরে কবিরাজী, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ক্ষেত্রে মেথির নানাবিধ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

মেথির পুষ্টিগুণ :- প্রাকৃতিক উপাদানটির মধ্যে রয়েছে ৩৫.৫ ক্যালরি, ৬.৪ গ্রাম প্রোটিন, ০.৭ গ্রাম ফ্যাট, ২.৭ গ্রাম ফাইবার এবং ৩.৭ মিলিগ্রাম আয়রন। এছাড়াও রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস এবং ভিটামিন বি৬-এর মতো পুষ্টিকর উপাদান, যা নানা দিক দিয়ে শরীর গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা :-

মেথিকে কী বলা উচিত , বা মেথির পরিচয় কী ? উত্তরে বলা চলে মসলা, খাবার, পথ্য—তিনটিই হিসেবে মেথি পরিচিত। স্বাদে তেতো হলেও পুষ্টিগুণে ভরপুর বলে অনেকেই মেথিকে সুপার ফুডও বলে অভিহিত করে থাকেন। মেথি অবশ্যই উপকারী এবং অতিরিক্ত ব্যবহার যদিও ক্ষতিকারক হতে পারে। তাহলে কথা না বাড়িয়ে আসুন আমরা জেনে নেই মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে।

১. ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে মেথির উপকারিতা –

ডায়াবেটিকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইলে মেথি আপনার জন্য অমৃত স্বরূপ হতে পারে। মেথিতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ফাইবার ও বিভিন্ন রকমের উপাদান যা রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে এনে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ডায়াবেটিক রোগীরা প্রতিদিন ৫ থেকে ৫০গ্রাম মেথি সেবন করুন। মেথিতে থাকা ফাইবার আপনার শরীরের সুগার ও কার্বোহাইড্রেট এর মাত্রা শোষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

২. ওজন কমাতে মেথির উপকারিতা :-

মেথিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার যা ওজন কমানোর জন্য খুবই কার্যকর। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন,ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম সহ বিভিন্ন উপাদান যা শরীরেকে সুস্থ রাখতেও সাহায্য করে। সকালে খালি পেটে মেথি ভেজানো জল খেতে পারলে তা দ্রুত ওজন কমাতে সহায়ক হবে।

৩. কোলেস্টেরল কমাতে মেথি :-

মেথিতে রয়েছে স্টেরিওডাল সেপোনিনস নামক একধরনের উপাদান যা শরীরের কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। মেথি শরীরের লিপো প্রোটিন বা ব্যাড প্রোটিন কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও মেথিতে উপস্থিত গ্লেকটোম্যানন নামক উপাদানটি হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

Read More : সকালে উঠে খালি পেটে এই ছয়টি খাবারে মিলবে উপকারিতা

৪. ক্যান্সার প্রতিরোধে মেথি :-

মেথিতে উপস্থিত ট্রাইগ্লিসেরাইড ইস্ট্রোজেন গ্রহণকারী মডিউলেটারের কাজ করে এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষগুলোকে উদ্দীপিত করে একটা সময় পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। এছাড়া গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে মেথির ব্যবহার করবার ফলে ক্যান্সার হবার আশঙ্কা কমেছে।ক্যান্সারের হাত থেকে মুক্তি পেতে ডাক্তারেরা রান্নায় মেথির ব্যবহারের কথা বলছেন।

৫. হজমে সহায়ক :-

মেথিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহের ক্ষতিকারক উপাদানগুলোকে দেহ থেকে বের করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি অন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এছাড়া বুকে বা পেটের ওপরের দিকে এসিডের প্রদাহ থেকে মুক্তি দেয় মেথি। সেই সঙ্গে হজমের যাবতীয় সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্যে ওষুধের মতো কাজ করে মেথি।

৬. কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি :-

কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে মেথি ভীষণভাবে কার্যকরী। ”Phytotheraphy Research”-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যায় ক্যালসিয়াম অক্সালেট জাতীয় কিডনির পাথর প্রতিরোধ করতে মেথিই যথেষ্ট। মেথি খেলে কিডনিতে উল্লেখযোগ্যভাবে কম ক্যালসিফিকেশন তৈরি হয়। মেথি ভাজা, সকালে খালি পেটে মেথি ভেজানো জল কিংবা মেথি দিয়ে তৈরি চা পান করলে কিডনি পরিষ্কার থাকে পাশাপাশি কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

৭. লিভারকে সুস্থ রাখে :-

২০০৭ সালে প্রকাশিত “জীববিজ্ঞান ও বিষবিদ্যাবিষয়ক” গবেষণায় এস কাভিয়ারসন বলেছেন, মেথি অ্যালকোহলযুক্ত ক্ষতির বিরুদ্ধে লিভারকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। দীর্ঘদিন অ্যালকোহলে আসক্ত মানুষদের চর্বিযুক্ত লিভার ও ফাইব্রোসিস থাকে যা কোলাজেন সংশ্লেষণের দ্বারা নির্মূল করা যেতে পারে। গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, মেথি লিভারে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইমগুলির ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

৮. বাতের ব্যথা উপশম :-

কোনও জ্বালা-যন্ত্রণা কমাতে মেথি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। গাঁটের ব্যথায় কষ্ট পেলে প্রতিদিন নিয়ম করে উষ্ণ গরম জলে মেথি বীজ ভিজিয়ে খেতে পারেন। অথবা, সারা রাত ভিজিয়ে রাখা মেথির জল সকালে খালি পেটে খেলেও অনেক উপকার পাবেন।

৯. মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ বাড়ায় :-

মেথিতে উপস্থিত থাকা ডায়োসজেনিন নামক পদার্থটি মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে। সদ্য মা হওয়া নারীর জন্য মেথির চা কিংবা সারারাত ভেজানো মেথির জল সকালে খালিপেটে খাওয়া উপকারী।

১০. মাসিকের ব্যথা দূর করে :-

প্রতিটি মেয়েকে প্রতিমাসে পিরিয়ড বা মাসিকের সম্মুখীন হতে হয়। এই সময় অনেকের ক্ষেত্রে যন্ত্রণা ও ব্যথা সহ্যাতীত হয়ে থাকে। গবেষণায় জানা গিয়েছে মেথি ব্যথানাশকের ভূমিকা পালন করে। পিরিয়ড চলাকালীন মেথির গুঁড়ো, মেথির চা কিংবা মেথি ভেজানো জল দিনে দু’বার খেলে নারীদের পিরিয়ডের ব্যাথ্যা কমে যায়।

১১. ত্বকের যত্নে মেথির উপকারিতা :-

ত্বকের পরিচর্যাতেও মেথির জুড়ি মেলা ভার। মেথির বীজে রয়েছে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল পদার্থ যা ত্বকের গভীরে গিয়ে ত্বককে সতেজ রাখে। এছাড়াও ব্রণের দাগ নির্মূল করতে মেথির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মেথির বীজে আছে ত্বকের মৃত কোষ তুলে দেবার ক্ষমতা। যা ত্বকের বার্ধক্য কমিয়ে ত্বককে সতেজ ও উজ্জ্বল দেখায়।

Read More : রসুনের উপকারিতা কি কি । রসুন খাওয়ার সঠিক নিয়ম

১২.পুরুষের যৌনক্ষমতা বাড়াতে মেথির ভূমিকা :-

মেথিতে থাকা ‘সাপোনিস’ বা ‘ডাইওসজেনিন’ নামক যৌগ পুরুষের যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অসামান্য ভূমিকা পালন করতে পারে। রোজ নিয়ম করে মেথি খেলে পুরুষের পৌরুষ বা যৌন ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। উল্লিখিত যৌগ আসলে টেস্টোস্টেরণ হরমোনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ;যা কামশক্তির মূল চালিকাশক্তি।

চুলের জন্য মেথির উপকারিতা :-

মেথিতে থাকা ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, এবং লিথিসিন নামক পদার্থ অকালে চুল পড়া এবং টাক পড়ে যাওয়ার সমস্যা থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও খুশকি কমাতে মেথির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মেথিতে রয়েছে ভিটামিন ই ও প্রাকৃতিক জেলোটিন যা চুলের জেল্লা, চুলের দৈর্ঘ্য ও চুলের স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। দুই টেবিল চামচ মেথি গরম জলে ফুটিয়ে নিয়ে ঠান্ডা করে সেই জলে চুল ভিজিয়ে রাখতে হবে। আধ ঘন্টা পরে ধুয়ে নিলেই কেল্লাফতে। এছাড়াও আমলকীর গুঁড়োর সঙ্গে মেথির গুঁড়ো মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে রেখে দিন। চুলের গোড়ায় সপ্তাহে এক দুই দিন মেখে ২০ মিনিট কাল রাখুন। এরপর ধুয়ে নিলেই দেখবেন চুলের অকালপক্কতা ম্যাজিকের মতো কমতে শুরু করেছে।

সকালে খালি পেটে মেথির জল খাওয়ার উপকারিতা :-

শরীরকে সম্পূর্ণ সুস্থ ও চনমনে রাখতে মেথির দানা জুড়ি মেলা ভার। মেথিতে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও মিনারেল সহ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা শরীরকে অনেক জটিল রোগ থেকে মুক্তি দেয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে মেথির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। একগ্লাস বিশুদ্ধ জলে ১ চামচ মেথি সারারাত ভিজিয়ে রাখুন সকালে খালি পেটে সেই জল টুকু পান করুন এতে মিলবে উপকার। কারণ মেথির মধ্যে দ্রবণীয় ফাইবার থাকে যা আপনার কোলেস্টেরল কমাতে অনেকটাই সাহায্য করবে। এছাড়া গ্যাস্ট্রিক কোষ্ঠকাঠিন্যসহ আরো অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

মেথির অপকারিতা :-

১. মেথিতে থাকা কৌমারিন নামক পদার্থ রক্তকে পাতলা করে । যাদের রক্তাল্পতা রয়েছে বা রক্ত পাতলা তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মেথি ব্যবহার করতে হবে।
২. সন্তানসম্ভবা নারীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মেথি গর্ভপাতের কারণ হতে পারে।
৩. যাদের মাত্রাতিরিক্ত সুগারের সমস্যা রয়েছে , তারা অবশ্যই ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী মেথি সেবন করুন । কেন না মেথি রক্তের সুগার কমায়, ফলে অন্যান্য ওষুধ সেবন করে থাকলে সুগারের মাত্রা প্রয়োজনের চেয়েও নীচে নেমে যেতে পারে।
৪. অনেকের মেথিতে এলার্জি থাকতে পারে। গা গুলানো , বমি ভাব থাকলে একটু সমঝে নিয়ে মেথি সেবন করলে ঝুঁকি এড়ানো যায়।

মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে আমাদের লেখাটি কেমন লাগলো তা আমাদেরটা কমেন্ট বক্সে জানাও। ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের  ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলের সাথে যুক্ত থাকো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *