খেজুরের উপকারিতা ও অপকারিতা । Health Benefits of Dates
বিভিন্ন ফলের গুনাগুন সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি । প্রচলিত ফলের মধ্যে বিশেষ গুণ সম্পন্ন ফল হচ্ছে খেজুর। কম বেশি সকলেই খেজুর খেতে ভালোবাসেন। সুস্বাদু এই ফলের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের উপকারী উপাদান । আশ্চর্যজনকভাবে এর উপকারী উপাদানের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। আসুন তাহলে কথা না বাড়িয়ে জেনে নিই খেজুরের উপকারিতা :-
খেজুরের ১০টি উপকারিতা :-
১। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে :-
খেজুরে থাকা নানান কার্যকরী উপাদান ও ফাইবার কোষ্টকাঠিন্য দূর করে । যদি প্রতিদিন চার-পাঁচটি করে খেজুর নিয়ম করে খান, তাহলে অপনার কোষ্টকাঠিন্য তিন সপ্তাহের মধ্যেই অনেকটা কমে যাবে ।
২। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় :-
খেজুরে থাকে ডায়াটারি ফাইবার । এই ফাইবার নানা ধরণের রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া নিয়মিত খেজুর খেতে পারলে LDL জাতীয় খারাপ কোলেস্টোরল মাত্রা দ্রুত হারে কমতে থাকব । খেজুরে থাকা প্রচুর মাত্রায় প্রাকৃতির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ-ব্যাধিকে দূরে সরিয়ে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ায় ও স্থায়িত্ব দান করে ।
৩। ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় :-
ক্যান্সার এক ভয়ংকর ব্যাধি আমরা সকলেই জানি । কিন্তু গবেষণায় জানা যায় প্রাকৃতিক ভাবেই এই মারণ ব্যাধির হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব । তার অন্যতম উপায় হল বিশেষ কিছু খাবার গ্রহণ । খেজুর সেই তালিকায় অন্যতম । নিয়মিত খেজুর খেলে ক্যানসারের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা যায় ।
৪। রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে :-
রক্তশূন্যতা বা রক্তাল্পতা দূর করতে খেজুরের জুড়ি মেলা ভার । এই শুকনো ফলটিতে থাকে প্রচুর পরিমাণ আয়রন । আর রক্তের হিমোগ্লোবিন এর প্রধান উপাদান হল আয়রন। খেজুরে থাকা আয়রন রক্তের হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করে রক্তাল্পতা দূর করে ।
৫। শরীরে শক্তির যোগান দেয় :-
পরিশ্রমী মানুষের শরীরে শক্তির প্রয়োজন । খেজুরে থাকা কার্বহাইড্রেড , প্রোটিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম , ফসফরাস ও নানারকম ভিটামিন একদিকে যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় , অন্যদিকে শক্তির যোগান দিয়ে দুর্বলতাকে দূর করে একটা ফ্রেশ আমেজ নিয়ে আসে।
Read More : রসুনের উপকারিতা কি কি
৬। দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে :-
চোখের রেটিনার সঠিক গঠনের জন্য ভিটামিন এ এর পাশাপাশি লিউটিন সহ আরো কিছু কার্যকর উপাদান প্রয়োজন। যেগুলি আপনি অতি সহজেই খেজুরের মধ্যে মজুত পেয়ে যাবেন। রাতকানা রোগ সহ উন্নত দৃষ্টিশক্তি ধরে রাখতে অবশ্যই খেজুরের উপর আস্থা রাখতে পারেন ।
৭। হাড় সুস্থ ও মজবুত রাখে :-
খেজুরে থাকে অনেকগুলি কার্যকরী উপাদান । হাড় সুস্থ ও মজবুত রাখতে ও খেজুরের উপকারিতা অসামান্য । এতে ভিটামিন, প্রোটিন, ক্যালসিয়ামও প্রচুর পরিমাণে সেলেনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে। এই সকল মিনারেল বা খনিজ পদার্থ হাড়ের সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । তাই আট থেকে আশি সকলেরই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় খেজুর রাখা প্রয়োজন।
৮। স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ায় :-
আমাদের স্নায়ুতন্ত্র প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল থাকে । সংবেদন বহন ও উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার কাজটি করে স্নায়ুতন্ত্র । এই স্নায়ুতন্ত্র গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যাবে খেজুরের মধ্যে । নিয়মিত খেজুর খেলে অলস ভাব যেমন দূর হবে , তেমনি চনমনে এক যৌবনী শক্তিলাভ করা যাবে ।
৯। উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে :-
খেজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম । যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে । তাই যাদের হাই প্রেসারের সমস্যা আছে প্রতিদিন ৩-৫ টি করে খেজুর খেলে যতেষ্ট উপকার পেয়ে যাবেন।
১০। ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায় :-
খেজুরে থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যালসিয়াম, আয়রন , ভিটামিন সমূহ মানুষের ত্বককে বুড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। উজ্জ্বল টানটান স্কিনের অধিকারী হতে চাইলে রোজ সকালে তিন, চারটি খেজুর খান । খেজুরের অসাধারণ গুনের জন্য আপনি নিশ্চই খেজুরের ভক্ত হয়ে উঠবেন।
খেজুরের অপকারিতা বা সাবধানতা :-
খেজুর খাবার আগে কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। শরীরে পটাশিয়াম বেশি থাকলে , কিংবা হাই ব্লাড সুগার থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খেজুর খাবেন । পেটের অসুখ বা ডায়রিয়া থাকলে খেজুর এড়িয়ে যান।
খেজুর খাবার নিয়ম :-
১। রাতে জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে ৪/৫ টি খেজুর খান ।
২। রাতে শোবার আগে একগ্লাস দুধের সঙ্গে খেজুর খেলে রক্ত বৃদ্ধি পায় ও রক্তাল্পতা দূর হয়।
৩। খাবার পরে ফলাহার হিসেবে ৪/৫টা খেজুর খেতে পারেন।
৪। টিফিন হিসেবে খেজুর রাখুন । একটা দুটো করে কয়েকবারে খাবেন ।
৫। ওজন কমাতে হলে ভাত খাবার ১৫ মিনিট আগে ৪/৫টা খেজুর খেয়ে নিন ।
৬। এছাড়া যে কোনো সময় খেজুর খেতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে একদিন অতি ভোজন নয়। নিয়মিত, অল্প করে খান এতে বেশি উপকার পাবেন।
৭। বাজারজাত খেজুরে ফাঙ্গাস ব্যাকটেরিয়া বা নোংরা থাকতে পারে। তাই চেষ্টা করুন ভালো জলে ধুয়ে নিতে।
খেজুর কীভাবে কিনবেন / কীভাবে বাছাই করবেন ভালো খেজুর :-
আমাদের দেশে শুকনো ভালো খেজুর প্রায় উৎপন্ন হয় না বললেই হয় । তাই নির্ভর করতে হয় বাইরের আমদানি করা খেজুরের উপর । তাই আসুন এবার আমরা জেনে নেই খেজুর কেনার ব্যাপারে কোন কোন দিকে নজর রাখতে হবে:-
i) খোলা খেজুর কিনবেন না । মশা মাছি সহ নানা ছত্রাক এতে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে থাকে।
ii) প্যাকেটজাত খেজুর কেনার সময় প্যাকেটের গায়ে লেখা দেখবেন যেন যতটা সম্ভব কারেন্ট আমদানি করা হয়।
iii) প্যাকেটের গায়ে কোনো ছেঁড়া ফাটা আছে কিনা ভালো করে দেখুন ।
iv) অনেকদিনের প্যাকেট দোকানদার গছিয়ে দিতে চাইছে কি না বুঝে নিন । ট্রান্সফারেন্ট প্লাস্টিক বা জারের ভেতরের খেজুরের কোয়ালিটি দেখে নিন ।
v) অনেক প্রজাতির খেজুর আছে । পছন্দের খেজুর কিনুন । কিন্তু খেজুর ফ্রেশ আছে কি না দেখুন। সাদা ফাঙ্গাস, কিংবা পোকা ধরে নি এটা নিশ্চিত করুন ।
vi) ফ্রেশ খেজুর কিনুন আর ঘরে বা ফ্রিজে সংরক্ষিত রাখুন । বেশিদিন খোলা প্যাকেটে ফেলে রাখবেন না।
Read More : ড্রাগন ফল কী ? ড্রাগন ফলের উপকারিতা
খেজুরের রসের উপকারিতা :-
একটা ধাঁধা খুব প্রচলিত ছিল ” বাড়িতে আছে কাঠের গাই/ বছর বছর দুধ খাই। ” এর উত্তর হল খেজুর গাছের রস। দুধের মত সাদা না হলেও কিন্তু উপকারের দিক থেকে দুধের সঙ্গে তুলনা হতেই পারে। শহরাঞ্চলে প্রায় দুষ্প্রাপ্য হতে চলা খেজুরের রস যদিও গ্রাম বাংলার এখনো পাওয়া যায় । আসুন এবার জেনে নিই খেজুরের রসের উপকারিতাগুলি :-
১। ডাবের জলের মতোই খেজুর গাছের রস এনার্জি ড্রিংকস হিসেবে কাজ করে। খেজুর রসে শর্করা বা ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ থাকে প্রায় ১৪-২১%। এই শর্করার সঙ্গে প্রচুর খনিজ লবণ ও মিনারেল থাকে। তাই বলা যায় যেকোন কৃত্রিম এনার্জি ড্রিংকস এর চাইতে বেশি ভালো ও স্বাস্থ্যকর। এক গ্লাস খেজুরের রস পান করলে নিমিষেই এনার্জি পাওয়া যায় সেইসঙ্গে ফ্রেশ একটা আমেজ অনুভূত হয়।
২। খেজুরের মতোই এনিমিয়া বা রক্তাল্পতা দূর করার মত আয়রন সহ বেশ কিছু মিনারেল খেজুর রসে পাওয়া যায়।
৩। খেজুরের রসে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম থাকে বলে পেশির দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে।
৪। খেজুরের রসে থাকা ম্যাগনেসিয়াম ক্লান্তি বা অবসন্ন ভাব দূর করে।
৫। খেজুরের রসে থাকা ফাইবার কোষ্টকাঠিন্য দূর করে।
৬। বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে ।
৭। উৎসেচকের ক্ষরণ সঠিক মাত্রায় করে হজমে সাহায্য করে।
৮। খেজুরের রস ক্ষুধামন্দা দূর করে।
খেজুরের রস কখন , কতটা খাবেন , কখন খাবেন না :-
১। খেজুরের রস খুব সকাল বা ভোরবেলায় খাওয়া ভালো।
২। বেলা বাড়তে থাকলে এতে ফারমেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়া হতে থাকে। এতে রসের স্বাদ নষ্ট হয় এবং অম্লতা বাড়ে। দিনের আলোতে গাঁজন বেশি হয়। তাই দিনের বেলা খেজুরের রস এড়িয়ে যাওয়াই ভালো ।
৩। একজন সুস্থ সবল মানুষ এক বা দুই গ্লাস রস খেতে পারেন । অভ্যাস না থাকলে হঠাৎ বেশি খেতে যাবেন না ।
৪। ব্লাড সুগার থাকলে খেজুরের রস এড়িয়ে যাওয়াই ভালো । এছাড়া ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খেতে পারেন।
৫। ভালো করে জেনে নিন রস ভালভাবে শুকিয়ে ছিল কিনা । বাদুড় জাতীয় প্রাণী এতে নানা রোগ ছড়াতে পারে ।
৬। খুব ঠান্ডা ক্ষতি করতে পারে তাই চেষ্টা করুন হালকা গরম করে খেজুরের রস খাওয়া যেতে পারে।
খেজুরের গুড়ের উপকারিতা :-
বাঙালির পিঠে পায়েস , মুড়ি বা রুটির সঙ্গে খেজুরের গুড়ের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মত। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি উৎসুক হয়ে থাকে খেজুরের গুড়ের জন্য। নলেন গুড়ের সন্দেশ কিংবা খেজুর গুড়ের মিষ্টি আমাদের খুব প্রিয়। গবেষকরা গুড়ের উপকারিতা সম্পর্কে অনেক কিছুই বলেছেন সত্য । কিন্তু খেজুরের গুড় সম্পর্কে একটু স্পেশাল কিছু উপকারিতার কথা বলেছেন । আসুন তাহলে কথা না বাড়িয়ে জেনে নিই খেজুরের গুড়ের উপকারিতাগুলি :-
১। শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করে রক্তাল্পতা দূর করে খেজুরের গুড়।
২। খেজুরের গুড়ে থাকা ফাইবার কোষ্টকাঠিন্য দূর করে ।
৩। পিএমএস সমস্যা বা প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম এ অনেক মহিলারা ভোগেন। প্রতিদিন নিয়ম করে অল্প পরিমাণ গুড় খেলে শরীরে হরমোনের সমতা বজায় থাকে ও এই সমস্যার থেকে দূরে থাকা যায়।
৪। উৎসেচকের ক্রিয়া নিয়ন্ত্রন করে হজমের শক্তি বাড়িয়ে দেয়।
৫। খেজুরের গুড় সর্দি, কাশি, ভাইরাল ফিবারের হাত থেকে রক্ষা করে ও শরীর গরম ও সতেজ রাখতে সাহায্য করে ।
৬। হাড়ের সমস্যা , গাঁটে ব্যাথা ইত্যাদি সমস্যা থেকে আরাম দেয় খেজুর গুড়।
৭। বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে খেজুরের গুড়।
৮। শরীরের টক্সিক উপাদান বাইরে বের করে শরীরকে সুস্থ সবল ফুরফুরে রাখতে খেজুর গুড় কার্যকরী ।
আশা করি বন্ধুরা খেজুরের উপকারিতা নিয়ে আজকের আর্টিকেল থেকে খেজুর, খেজুরের রস ও খেজুরের গুড়ের উপিকারিতা সম্পর্কে জানলাম । আমাদের সঙ্গে থেকে ফেসবুক পেজ লাইক করে পড়তে থাকুন এরকম আরো অনেক আর্টিকেল । পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।