আব্রাহাম মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব । Hierarchy of Needs Theory
আব্রাহাম মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব
যেকোনো প্রাণীর আচরণ উদ্দেশ্যমূলক। কিন্তু উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাই হোক না কেন, যতক্ষন পর্যন্ত কোনো প্রাণীর কাছে সেটা অর্জন করার জন্য একটা অভ্যন্তরীণ প্রেরণা বা তাগিদ কাজ করছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেই আচরণটি সম্পন্ন হবে না বা আচরণের মধ্যে একটা সংহতি ও ধারাবাহিকতা আসবে না। পাখিরা বাসা বাঁধে, প্রাণীরা খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে, মানুষ সন্তান প্রতিপালন করে, ছাত্রছাত্রীরা ভালো ফল করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। এসব কাজ করার জন্য তাদের কেউ বাধ্য করে না, অন্তরের তাগিদে স্বেচ্ছায় তারা এই রকম অসংখ্য কাজ করে। এই অভ্যন্তরীণ তাগিদটা এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম। কখনও শারীরিক তাগিদ-ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌনতা আবার কখনও আত্মরক্ষার তাগিদ, কখনও বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি পাওয়ার তাগিদ। এই তাগিদের নাম হল প্রেষণা(Motivation)। অতএব প্রেষণা হল উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রকৃষ্ট বাসনা বা তীব্র আকাঙ্ক্ষাজনিত একটি গতিশীল অবস্থা- যা লক্ষ্য বস্তু না পাওয়া পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে।
আব্রাহাম মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব বা হায়ারার্কি অফ নিডস থিয়োরি :-
প্রেষণার ভিত্তি হিসাবে চাহিদা পূরণের ক্রমপর্যায় কে গুরুত্ব দিয়ে মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলো চাহিদা সোপান তত্ত্ব বা হায়ারার্কি অফ নিডস থিয়োরিটি দাঁড় করান। ১৯৪৩ সালে মাসলো ‘সাইকোলজিকাল রিভিউ’ তথা ‘মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা’ পত্রিকায় তাঁর ‘মানব প্রেষণা তত্ত্ব’ নামক গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। তাঁর মতে জীবজগতে প্রত্যেকটি প্রাণীকে বেঁচে থাকতে হলে একান্ত আবশ্যক কিছু চাহিদা পূরণ হওয়া দরকার। এতে তিনি মূলত পাঁচ রকমের চাহিদা বা প্রয়োজনের কথা বলেছেন —
ম্যাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্বের পাঁচটি ধাপ :
১.দৈহিক চাহিদা (ফিজিওলজিক্যাল নিডস)
২.নিরাপত্তার চাহিদা (সেফটি নিডস)
৩.ভালোবাসা ও একাত্মতার চাহিদা (নিড ফর লাভ এন্ড বিলঙ্গিংনেস )
৪.আত্মমর্যাদার চাহিদা (এস্টিম নিডস )
৫.আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা ( নিড ফর সেলফ-অ্যাকচুয়ালাইজেশন)
মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্বকে পিরামিডের সঙ্গে তুলনা করলে বুঝতে সুবিধা হয়। এই পিরামিডে প্রাথমিক চাহিদাগুলো থাকে নিচের স্তরে। এরপর বাকিগুলো ক্রমশঃ উচ্চতর স্তরে উঠতে থাকে। এইভাবে সবার উপরে থাকে আত্মোপলব্ধির স্তরটি। অর্থাৎ সহজ করে বলতে হয় যে, ব্যক্তির মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার পরেই সে উচ্চতর চাহিদা পূরণের পথে পা বাড়াতে চেষ্টা করে । উচ্চতর স্তরের চাহিদা সমূহ পূরণ করার প্রেরণা আসে আগের স্তরের চাহিদাগুলো পূরণ করার মাধ্যমেই।
পিরামিড এর স্তরগুলির মধ্যে মাসলোর মতে প্রথম চারটি স্তর হল ‘ন্যূনতম চাহিদা’। যার মধ্যে পড়ে সম্মান, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও জৈবিক চাহিদা। ‘ন্যূনতম চাহিদা’ পূরণ না হলে মৌলিক (জৈবিক) চাহিদা বাদে বাকি চাহিদাগুলোর জন্য হয়তো কোনো শারীরিক আগ্রহের লক্ষণ দেখা যাবে না। যদিও মানুষ ভিতর থেকে উদ্বেগ অনুভব করবে। মাসলোর তত্ত্ব বলে, মৌলিক চাহিদাগুলো আগে পূরণ হতে হওয়া চাই। তারপর মানুষের মধ্যে পরবর্তী উচ্চতর চাহিদার জন্য তাগিদ তৈরি হবে। অর্থাৎ পূর্বের চাহিদা পূরণ হওয়ার পরই পরবর্তী স্তরের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হবে। এসবের আলোচনাসূত্রে মাসলো ‘মেটামোটিভেশন’ কথাটি ব্যবহার করেন। যার অর্থ আত্মোপলব্ধি অর্জনের পথে অগ্রসর হন যারা, তারা পূর্বেই নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করেছেন।
মানুষের মস্তিষ্ক একই সময়ে সমান্তরাল বেশ কিছু প্রক্রিয়ায় চলতে থাকে, অতএব মাসলোর তত্ব অনুযায়ী হায়ারারকির স্তরগুলিতে বিভিন্ন প্রেরণা একই সময়ে ঘটতে পারে বলে স্বীকার করা হয়েছে। মাসলো এই স্তরগুলোর “আপেক্ষিক”, “সাধারণ” এবং “প্রাথমিকভাবে” এদের ভেতরের সম্পর্ক ও সন্তুষ্ট হওয়ার শর্ত সম্পর্কেও ধারণা দিয়ে গেছেন। দেখা যায় একজন ব্যক্তি কোনো সময়ে নির্দিষ্ট প্রয়োজনের দিকে মনোনিবেশ করে , তার বদলে, মাসলো বলেন যে একটি সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনই মানবজীবনের ওপর “আধিপত্য” বিস্তার করে থাকে।
মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব, মৌলিক চাহিদাগুলো একটি পিরামিডের সাথে তুলনা করে নিম্নে চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হল –
১.দৈহিক চাহিদা (ফিজিওলজিক্যাল নিডস) :-
নূন্যতম বাঁচার বা জীবন ধারনের প্রয়োজনকে জৈবিক বা দৈহিক চাহিদা বলে। শারীরিক তথা জৈবিক চাহিদা একটি বিশ্বব্যাপী চাহিদা। এটা মানুষের প্রাথমিক চাহিদা। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা,কাম,বাসস্থান ইত্যাদি। প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য এই চাহিদার পূরণ অপরিহার্য। এই চাহিদাগুলি না মিটলে মানুষের শক্তির অভাব ঘটে ও পরবর্তী চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে তার সক্রিয়তা ব্যাহত হয়। মাসলোর তত্ত্ব মতে, মানুষ এসব জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য। ব্যক্তি যদি উচ্চতর চাহিদার খোঁজেও যায়, তবুও সে আগে এসব জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য। যদি এসব চাহিদা পূরণ না হয়, তবে ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের অতৃপ্তির জন্ম হয়। এর বিপরীতে, ব্যক্তির মধ্যে যখন অতৃপ্তির জন্ম হয়, তখন ব্যক্তির মধ্যকার প্রেষণা হ্রাস পায় এবং অতৃপ্তির বৃদ্ধি ঘটে। তাই সর্বপ্রথম নিম্নস্তরের এই চাহিদাগুলি মেটানো জরুরি তবেই ব্যক্তি উচ্চস্তরের চাহিদা পূরণে ধাবিত হতে পারবে।
২.নিরাপত্তার চাহিদা (সেফটি নিডস) :-
এই চাহিদার স্থান জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় চাহিদার উপরে। জৈবিক চাহিদাগুলি পূরণ হলেই ব্যক্তির মধ্যে নিরাপত্তার চাহিদা জাগ্রত হয়। নিরাপত্তার চাহিদা পূরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির মধ্যে নিরাপত্তা ও সুরক্ষাবোধের সৃষ্টি। এই চাহিদার অন্তর্ভুক্ত হল মানসিক ও দৈহিক নিরাপত্তা, আশ্রয়ের নিরাপত্তা,পারিবারিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা,কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা ইত্যাদি। এই চাহিদা শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কারণ শিশুরা অসহায় তাই তারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করে বেশি। কোনো ব্যক্তি উচ্চতর স্তরে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়। যদি নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ না হয় তবে উচ্চতর স্তরে যাওয়ার আগে যেকোনো উপায়ে সে সেটিকেই পূরণ করতে চায়। যদি সেটি না হয় তবে নিরাপত্তার চাহিদার অভাব থেকে নানারকম বৈষম্য মূলক আচরণ দেখা দিতে পারে।
৩.ভালোবাসা ও একাত্মতার চাহিদা (নিডস ফর লাভ এন্ড বিলঙ্গিংনেস ) :-
জৈবিক এবং নিরাপত্তার চাহিদা পূরণের পরে, মানুষের প্রয়োজনের তৃতীয় স্তরটি হল ভালোবাসা ও একাত্মতার চাহিদা। পরিবার, স্বজন, বন্ধু ইত্যাদি ও তাদের সঙ্গে পারস্পরিক ভালোবাসার আদানপ্রদানের চাহিদা এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত। মাসলোর মতে, এই বলয়গুলো বড় বা ছোট যাই হোক না কেন, মানুষ এসব সামাজিক বলয়গুলোর মধ্যে স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার অনুভূতি অনুভব করতে চায়। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ একা থাকতে পারে না। একাকীত্ববোধ থেকে সৃষ্টি হয় সঙ্গলাভের চাহিদা। এই চাহিদা সামাজিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত। মানুষ অন্যকে ভালোবাসতে চায় এবং অন্যের ভালোবাসা পেতে চায়। জৈবিক ও নিরাপত্তার চাহিদাগুলি পূরণ হওয়ার পরেও যদি ভালোবাসা ও একাত্মতার চাহিদা পূরণ না হয় তাহলেও ব্যক্তিজীবন হতাশায় নিমজ্জিত হতে পারে। কারণ প্রতিটি মানুষ ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গতা চায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের মধ্যেই এই চাহিদা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, গোষ্ঠী বা যেকোন সংবদ্ধতায় ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গতা পেতে চায়। এর অভাবে ব্যক্তিজীবন একাকীত্বের শিকার হয়ে মারাত্মক হতাশায় পর্যবসিত হতে পারে।
৪.আত্নমর্যাদার চাহিদা(এস্টিম নিডস ) :-
পূর্বোক্ত চাহিদাগুলি পূরণের মাধ্যমে, মানুষের মধ্যে নিজের সমন্ধে একটি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠে। ফলে ব্যাক্তির মধ্যে মান-মর্যাদা বা অহমবোধজনিত চাহিদার উদ্ভব হয়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এই আত্মমর্যাদার চাহিদা বিদ্যমান রয়েছে। সে সচেতন হয় অন্যেরা যাতে তাকে যথেষ্ট মূল্য দেয় এবং নিজেকে একজন ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা,কৃতত্ব অর্জন,গুণাবলি ইত্যাদি সমন্ধে একটা প্রত্যয় তাকে উদ্বুদ্ধ করে সেগুলির সদ্ব্যবহার করতে। মনোবিদ ম্যাসলো(Maslow) বলেছেন,”All people need a stable, firmly based high evaluation of themselves.” এই চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির মধ্যে আত্মশ্রদ্ধার প্রেষণা(Esteem Motive) জাগ্রত হয়।
৫.আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা ( নিড ফর সেলফ-অ্যাকচুয়ালাইজেশন) :-
প্রত্যেক মানুষ চায়,তার মধ্যে যা কিছু ক্ষমতা এবং সম্ভাবনা আছে,তাকে বাস্তবে রূপ দান করতে। আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে। আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা বা আত্মপ্রকাশের চাহিদা মানুষের সর্বোচ্চ স্তরের চাহিদা। প্রথম চারটি স্তরের চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ হলেও মানুষের মধ্যে একটা অতৃপ্তি থেকে যায় যার ফলে সে আত্মপ্রতিষ্ঠার একটা কাল্পনিক চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকে। অর্থাৎ আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা মানুষের জীবনের অধিকাংশকাল জুড়ে তাকে সক্রিয়তায় নিয়োজিত রাখে। মনোবিদ ‘বার্নার্ড(Barnard) বলেছেন,” What a person can be, he must be-his potentialist tend to be actualized.“মাসলো একে বলেছেন, একজন ব্যক্তি যা কিছু অর্জন করতে পারে তার আকাঙ্ক্ষা করা, একজন ব্যক্তি যা কিছু হতে পারে তার সবটুকু হওয়া।অর্থাৎ মানুষ তার সৃজনশীলতা , কর্মময়তার দ্বারা সমাজের মানুষের মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে অমরত্বলাভ করতে চায় । এই পর্যায়ে মানুষ যেন প্রকৃতির মতোই নিজেকে বিস্তারিত করে দিতে চায় পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যাতে মৃত্যুর পরেও তার কাজের মাধ্যমে মানুষের মাঝে বিরাজ করতে পারে । এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের “সোনার তরী ” কবিতার কথা মনে পড়ে যায় । শরীর কে মহাকাল নিয়ে যেতে পারে না , কিন্তু মানুষের কর্মগুলোকে মহাকাল যুগ থেকে যুগান্তরে পৌঁছে দেয় — এভাবেই মানুষ অমরত্ব লাভ করে থাকে । আর মাসলোর চাহিদা শেষ পর্যায়ে হয়তো মানুষ চায় শরীরী উপিস্থিতির উর্ধে একটা দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ।
আরও পড়ুন : মানসিক স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা, গুরুত্ব এবং তা ভালো রাখার কয়টি উপায়
খুব সহজে বলা যায় , মানুষ তার চাহিদা একটা পূরণ হলেই আরেকটি চাহিদা পূরণের দিকে ধাবিত হয় । চাহিদা সবসময় সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ স্তরে ধাবিত হতে থাকে । এটাই মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব ।
বন্ধুরা আব্রাহাম মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব নিয়ে লেখাটি কেমন লাগলো তা আমাদের কমেন্ট বক্সে জানায়। ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে যুক্ত থাকো।