শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা
শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা
কথায় বলে শিশুর প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল তার পরিবার। কাজেই একজন শিশুর শারীরিক , মানসিক , প্রক্ষোভিক, সামাজিক প্রভৃতি বিকাশগুলি ঘটতে শুরু করে পরিবারের মধ্যেই। বর্তমান ডিজিটাল যুগে একটি গবেষণায় উঠে এসেছে মানুষের মানসিক সমস্যা সংক্রামক ব্যাধির মতো ক্রমবর্ধমান। তাই যদি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই পূর্ণ মানসিকতার সুষম বিকাশ ঘটানো যায় তবে ভবিষ্যৎ জীবনে শিশু নানারকম মানসিক সমস্যার মোকাবিলা করে একজন সুস্থ সবল সামাজিক মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। আর এই মানসিক দিকগুলো গড়ে উঠতে পারে একমাত্র পরিবারের মধ্যেকার পরিবেশে।
বর্তমান যুগে সোশ্যাল মিডিয়া ,যন্ত্র নির্ভরতা ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের অভাব প্রভৃতির ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদান কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব সুকোমল শিশুদের মনে পড়ে। ফলে শিশুরা নানাভাবেই বিকৃত মানসিকতার শিকার হয় এবং মোবাইল গেম , ভিডিও গেমে আসক্তি , অসামাজিক ভাবনা , নেশার প্রতি আসক্তি ইত্যাদির কবলে পরে যায়। এসব অনেক সময় বাইরের থেকে শিশুকে দেখে বোঝা যায় না। কিংবা বোঝা গেলেও অনেকেই বিশেষ আমল দেন না। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার যেমন শরীরকে সুস্থ রাখে তেমনি উপযুক্ত পারিবারিক পরিবেশ -ই শিশুর মানসিক গঠনকে সুন্দর করে তোলে। তাই শিশুর মানসিক বিকাশের দিকটি গুরুত্ব দেওয়া খুব প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আজ।
জেনে নেওয়া যাক যে কয়টি বিষয়কে নজরে রাখলে শিশুর মানসিক বিকাশকে সুষম করে তোলা যায় তার পরিবারের মধ্যেই –
১. খোলামেলা আলোচনা :-
মনে রাখা প্রয়োজন যে মন খুলে আলোচনা করলে মনের গভীরে কোনো ক্ষত জমা থাকে না। একজন মানুষের অনেক অভাব অভিযোগ না পাওয়ার বেদনা থাকতে পারে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য যদি নিজের খোলামেলা কথা বলে তবে তার প্রভাব শিশুর ওপর পড়তে বাধ্য। এর ফলে শিশুও তার স্কুলের বন্ধুদের বা শিক্ষক শিক্ষিকাদের সম্পর্কে মনোভাব খোলাখুলি বলবে – যার ফলে তার ভেতরে কোনো লুকোনো আবেগ বা ক্ষত তৈরি হবে না।
২. খেলা ও গল্প বলা :-
তোমার জন্য অনেক টাকা খরচ করছি , কত দামি খেলনা কিনে দিচ্ছি ‘- বন্ধুরা এইসব কথার চেয়ে যেটা জরুরি সেটা হলো – দামি খেলনা নয় – সঙ্গী হতে হবে। ছোটদের সঙ্গে খেলার সুযোগে অনেক কিছু শিক্ষাদানও সম্ভব হয়। মনে রাখতে হবে শিশুরা দামি খেলনা নয় – খেলার দামি সঙ্গ চায় বেশি।
আগেকার দিনে ঠাকুমা, দাদু, দিদাদের মুখে রূপকথার নানা গল্প শুনতে পারতো শিশুরা। বর্তমান যুগে সেই সুযোগ তাদের অনেক কম। শিশুরা গল্প শুনতে ভালোবাসে। তাদের কল্পনাপ্রবণ মন পাখা বিস্তার করতে পারে গল্পের মাধ্যমে। এর ফলে শিশুর মানসিক শক্তি দৃঢ়তা লাভ করে থাকে।
৩. সৃজনশীল কাজ বা খেলনা :-
শিশুর খেলনা হতে হবে আবিষ্কারধর্মী, নাটকীয় ও সৃজনশীল। কোনো কিছু নির্মাণ করা শিশুদের আগ্রহের বিষয়। বয়সভেদে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ উপযোগী খেলনা নির্বাচনে পরিবারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। যে খেলনাগুলো শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক হবে। কখনো কখনো সাধারণ গৃহকাজের সামগ্রীও তাদের মজার খেলার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। রুটি বানানোর সময় একটা আটার গলা দিয়ে বোলো তুমি এটা দিয়ে কী কী বানাতে পারো। দেখবে সাপ ব্যাঙ কত কি ওদের কল্পনায় চলে আসছে যাকে বাস্তব রূপ দিতে চেষ্টা করবে।
জেনে নাও : শীতে ঠোঁটের যত্ন নেওয়ার কিছু টিপস
৪. বই পড়া :-
বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বই পড়ার মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ প্রসারিত হয় এবং মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ে। শিশু বয়েস থেকেই তাই শিক্ষামূলক বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। মাঝে মাঝে নানা ধরণের মজার মজার কাহিনীমূলক বই শিশুদের উপহার দিতে হবে। এতে শিশুদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে শিশুর বুদ্ধিমত্তা।
৫. মর্যাদা দান :-
আমরা কিন্তু শিশুদের ইচ্ছা ও ভাবনাগুলোকে অনেক সময় পাত্তা না দিয়ে তাদের ভাবনায় আঘাত করে থাকি। ছোটো বলে তাদের সিদ্ধান্ত বা পরামর্শগুলো নিয়ে ঠাট্টা করে বসি । এতে তার শিশু মন আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ধীরে ধীরে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শৈশব থেকেই যদি তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাদের আলাদা করে মর্যাদা দান করা হয় তবেই সেই শিশুটির চিন্তন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তারাও অন্যদের সম্মান করতে শিখবে। পরিবারের উচিত শিশুদের কথাগুলো মন দিয়ে শোনা ও বোঝার চেষ্টা করা।
জেনে নাও : যে ৮টি কথা সন্তানকে বলা যাবে না
৬. ছবি আঁকা সংগীতচর্চা করা ইত্যাদি :-
শিল্পচর্চার মাধ্যমে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। ছবি আঁকার মাধ্যমে তার কল্পনা শক্তি যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি গান শোনার মাধ্যমে তার মনের ওপর চাপ অনেকটা কমে যায়। গান শুনলে মস্তিস্ক থেকে ডোপামিন নামক এক প্রকার হরমোন নিঃসৃত হয় যা শিশুকে উদ্দীপনায় ভরিয়ে রাখে। ফলে শিশুরা অসাধারণভাবে ভাবতে ও চিন্তা করতে শেখে। নতুন নতুন সমস্যা সমাধানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাই ছোটবেলা থেকেই ছবিআঁকা ও সংগীতের সাথে পরিচয় করানো উচিত।
৭. অধিক সময় কাটানো :-
আজকালকার বাবা মায়েদের চাকরিসূত্রে দিনের অনেকটা সময় কর্মস্থলে কাটাতে হয়। ফলে শিশুরা বাবা মায়ের সঠিক সান্নিধ্য পেয়ে ওঠে না। অনেকেই আবার সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ফলে ক্লান্তিবোধ করে , কারো কারো মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় সেই মেজাজ গিয়ে পরে শিশুদের ওপর ফলে শিশুরা আরো বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয় , একাকীত্ব বোধ করে। তার শিশু মনে জেগে ওঠা হাজারো রকম প্রশ্ন তার মনে চাপা পড়ে যায়। ধীরে ধীরে তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। তাই যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন শিশুদের সাথে একটা কোয়ালিটি টাইম কাটানো উচিত বাবা মায়েদের। পরিবারেরও উচিত তাদের মনের কথা খুলে বলা।
এই বিষয় গুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয়ে নজর রাখা প্রয়োজন – ব্যর্থ হলে কখনো শাস্তি দেওয়া কিংবা বকাবকি করা অনুচিত। আর মনে রাখা প্রয়োজন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে বন্ধন তাও শিশুর মনকে প্রভাবিত করে। তাই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হতে পারে কিন্তু এমন কথা কাউকে বলা উচিত নয় – যা শিশুরা শিখে গেলে তার ক্ষতি হতে পারে। মা বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সম্পর্ক শিশু মনে পরম সুখ ও নিরাপত্তাবোধ জাগায়।
বন্ধুরা আশা করি লেখাটি পরে বুঝতে পেরেছো শিশুদের শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ । লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলো না যেন। আমাদের ফেসবুক পেজের সঙ্গে থেকো। আর খুব ভালো থেকো।