ভারতে আধুনিক শিক্ষার বিকাশে সমাজসংস্কারক ও শিক্ষাসংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা
“Rammohan was the only person in his time,in the whole world of man to realise completely the significance of the Modern Age.“- Rabindranath Tagore
“ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাসে রাজা রামমোহন রায় আধুনিকতার অগ্রদূত।“- বিপিনচন্দ্র পাল
আধুনিক যুগে প্রবেশ করেও ভারত যখন কুসংস্কার , অশিক্ষা ও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালে আটকে পড়েছিল , ঠিক তখনই আবির্ভাব ঘটে ভারত পথিক রামমোহন রায়ের। নতুন পথের দিশারি মানব প্রেমিক রাজা রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২২ মে ১৭৭২(মতান্তরে ১৭৭৪) খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার অন্তর্গত খানাকুলে কৃষ্ণনগরের সন্নিহিত রাধানগর গ্রামে, এক সম্পন্ন বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ছিল রমাকান্ত রায়, মাতার নাম তারিণী দেবী। প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কার্য করতেন। সেই সূত্রেই ‘রায়’ পদবীর ব্যবহার বলে অনুমান করা হয়। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়কে বলা হয় ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পেরেছিলেন। তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন, সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টার জন্য।
শিক্ষাসংস্কারক রাজা রামমোহন রায় :-
রাজা রামমোহন রায় যেমন সমাজসংস্কার তেমনি তিনি শিক্ষাসংস্কারক। তিনি বিশ্বাস করতেন
জাতিকে অজ্ঞাত ও জড়তা থেকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা ও যুক্তিবিদ। তাই তিনি প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ ও শাশ্বত চিন্তাধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের সমন্বয় ঘটিয়ে নবভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই রাজা রামমোহন রায়কে ভারতীয় শিক্ষা প্রসারের পথিকৃৎ বলা হয়
১.শিক্ষার লক্ষ্য:-
রামমোহন রায় মনে করতেন শিক্ষার লক্ষ্য হবে ব্যক্তি ও সমাজকল্যাণ। শিক্ষার মাধ্যমে যাতে শিশুর চিন্তা চেতনা ও যুক্তিবাদী মননের বিকাশ ঘটে। শিক্ষার মাধ্যমে তিনি মানুষের মনে পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষার মাধ্যমে- পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় দিকগুলিকে গ্রহণ করে প্রাচ্যশিক্ষার পুনুরুজ্জীবন ঘটানোর কথা বলেছেন। সাথে ভারতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট দিকগুলিকে সংরক্ষণ করে জনগণের নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন।
২.পাঠক্রম :-
রামমোহন রায় পাঠক্রমে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি দেশে উদার্ধর্মী এবং জ্ঞানদীপ্ত বিষয়গুলি পড়ানোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি শিক্ষার পাঠক্রমে বিজ্ঞান,গণিত, রসায়নশাস্ত্র
শারীরতত্ব প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে মত প্রকাশ করেন। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইঙ্গ-বৈদিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে তিনি ইউক্লিডের জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং যন্ত্রবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেন।
৩.পুস্তক রচনা ও অনুবাদ :-
রাজা রামমোহন রায়ের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবিতে) তুহফাতুল মুহাহহিদিন। বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রাহ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র ও তাঁর সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সব রকমের বিকাশের জন্য বহু সংস্কৃত বই বাংলায় অনুবাদ করেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ মধ্যে প্রায় তিরিশখানি পুস্তক রচনা করে ছিলেন তিনি। প্রাচীন গ্রন্থের অনুবাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বেদান্তগ্রন্থ,’ ‘বেদান্তসার’,’কেনোপনিষদ’, ‘ঈশোপনিষদ’, ‘কঠোপনিষদ,’, প্রভৃতি। এছাড়াও তিনি ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’,ও ‘ব্রাহ্মসঙ্গীত’, রচনা করেছিলেন।
৪.বাংলা গদ্যসাহিত্যে অবদান :-
বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক হিসেবে সমালোচকগণ রামমোহন রায়কেই স্বীকৃতি দিতে চান । বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদানগুলি খুব সংক্ষেপে নিম্নরূপ :-
ক) তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যকে সংস্কৃতের গ্রাস থেকে মুক্ত করেন ।
খ) তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যকে সামাজিক প্রয়োজনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন ।
খ) বাংলা ভাষাকে যে কাজের ক্ষত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যায় তা তিনিই প্রথম করে দেখান ।
গ) ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ এর মাধ্যমে বাংলা ভাষার সুষম গঠনটিকে দাঁড় করিয়েছেন ।
ঘ) বাংলা গদ্যকে যুক্তি তর্কের ক্ষেত্রেও যে সুন্দরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব তা রামমোহনই প্রথম দেখিয়েছেন ।
ঙ) বাংলা গদ্য পুস্তক রচনা করে শিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন বিপ্লব ঘটিয়েছেন , তেমনি সংবাদপত্র প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা গদ্যের ব্যবহারকে সর্বজনীন করে তুলেছেন তিনি ।
৫.ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রসার :-
রাজা রামমোহনের হাত ধরে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রসার ভারতে ঘটতে শুরু করেছিল। তিনি ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য অনেক উন্নতমানের, যার চর্চা করলে সমগ্র বিশ্ব ও সাহিত্যের সঙ্গে শিশুর যেমন পরিচয় ঘটবে তেমনি নতুন চিন্তা চেতনার দ্বার উন্মোচিত হবে। এই জাগরণ ব্যক্তিকে তাঁর ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীন বিকাশে সহয়তা করে সমাজকে উন্নত করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।
৬.স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার :-
স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে রামমোহন রায় যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন । ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ‘সংক্ষিপ্ত মন্তব্য’ নামক বই – এ নারীদের প্রাচীন অধিকারের বর্তমান সংকোচনের ওপর তিনি আলোকপাত করেন। এতে তিনি ভারতের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের উদাহরণ দিয়ে বোঝান যে অতি প্রাচীনকালেও নারীশিক্ষার প্রচলিত ছিল এবং সমাজে তাঁরা বিশেষ মর্যাদা পেতেন। পরবর্তী যুগে নারীদের শিক্ষার অধিকার অনেকটাই সংকুচিত হয়ে যায়, তাই আধুনিক ভারতের অন্যতম প্রতিভূ রামমোহন নারীদের শিক্ষার অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হন যা এই বইটিতে যুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরেন। এর পদক্ষেপ হিসেবে তিনি নারীশিক্ষাকে সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে দিতে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন এবং অন্যেদের ও আহ্বান করেছিলেন।
৭. সংবাদপত্র প্রকাশের মাধ্যমে জনশিক্ষা প্রসার :-
সংবাদপত্র প্রকাশের মাধ্যমে জনশিক্ষা প্রসারে বিশেষ ভূমিকা করেছিলেন রামমোহন রায়। তিনি মনে করতেন শিক্ষাই মানুষকে প্রকৃত পথের সন্ধান দিতে পারে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলি হল- ‘ সম্বাদ কৌমুদী’, ‘মিরাত-উল-আকবর’, ‘The Brahmanical Magazine’, ইত্যাদি। এই সমস্ত পত্রিকাগুলিতে তৎকালীন সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ ও আলোচনা থাকত। এছাড়া জনসাধারণের কল্যাণসাধন ও জনমত গঠনের ক্ষত্রেও পত্রপত্রিকাগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সমাজ সংস্কার রামমোহন :-
রামমোহন রায়কে তার সমাজ সংস্কারের উদ্যোগের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারত পথিক ‘ উপাধিতে ভূষিত করেন । দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় আকবর ১৮৩১ সালে রামমোহন যখন ইংল্যান্ড রওনা দেন, তখন তাকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। । রামমোহনের বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারমূলক কাজ গুলিকে খুব সংক্ষেপে নীচে লেখা হল:-
ক) সতীদাহ প্রথা নিবারণ :-
আমাদের দেশে তখন ভয়ঙ্কর কুপ্রথা ‘সতীদাহ প্রথা’ প্রচলিত ছিল । রামমোহন রায় প্রথম উদ্যোগ নিয়ে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর বদান্যতায় ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা নিবারণ আইন পাশ করান।
খ) বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের তীব্র প্রতিবাদ করেন রামমোহন রায় । তিনি নিয়মিত যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সংবাপত্রের পাতায় তার মতকে প্রতিষ্ঠিত করে জনমত গড়ে তোলেন ।
গ) সরকারি চাকুরিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন ।
ঘ) সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে তিনি নারীকেও সমান অধিকার দেবার পক্ষে আন্দোলন করেন ।
ঙ) সর্বত্রই নারী পুরুষের সাম্য ও অধিকারের সমতার দ্বারা সামাজিক উন্নয়নের পথটিকে তিনি উপলব্ধি করেন ।
চ) সমাজের উন্নতির জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা ও উন্নত বিজ্ঞান মনষ্কতার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন ও শিক্ষা বিস্তারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ।
ছ) রামমোহন রায় উপলব্ধি করেন সামাজিক সংস্কারের জন্য চাই শিক্ষা বিস্তার ও জনসচেতনতা । তাই তিনি সংবাদপত্র প্রকাশ করে যুক্তির মাধ্যমে সমাজের কুপ্রথার বিরোধিতা ও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে যেমন তুলে ধরেন, তেমনি সমাজে এক সংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলে যুগের গতিকে ত্বরান্বিত করেন ।
জ) মানুষের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য তিনি ধর্মীয় সংস্কার করে ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠিত করেন ।
রামমোহনের হাত ধরেই ভারতবর্ষ আধুনিক যুগে পা রেখেছিল। রামমোহনের জীবনীকার সোফিয়া-ডি-কোলেট সংস্কারক রামমোহনের মূল্যায়নে লিখেছিলেন- ” ইতিহাসে রামমোহন হলেন এক জীবন্ত সেতু, যার ওপর দিয়ে ভারতবর্ষ তার বিশাল অতীত থেকে অসীম ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হয়েছে।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যথার্থই লিখেছেন , ‘‘বর্তমান বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন রামমোহন রায়। আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, তাঁহার নির্মিত ভবনে বাস করিতেছি। তিনি আমাদের জন্য যে কত করিয়াছেন, কত করিতে পারিয়াছেন, তাহা ভালো করিয়া আলোচনা করিয়া দেখিলে তাঁহার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও বিশ্বাস জন্মিবে। আমাদিগকে যদি কেহ বাঙালি বলিয়া অবহেলা করে আমরা বলিব, রামমোহন রায় বাঙালি ছিলেন।’’ মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্রিটেনের ব্রিস্টলে ১৮৩৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর রাজা রামমোহন রায়ের জীবনাসন ঘটে।
রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী নিয়ে লেখাটি কেমন লাগলো কমেন্টে আমাদের জানাও। ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটি ফলো করো।