নিউরোপ্লাস্টিসিটি কি ? মস্তিষ্কের সুগঠনে নিউরোপ্লাস্টিসিটির ভূমিকা
Neuroplasticity বা নিউরোপ্লাস্টিসিটি কি ?
ছোটবেলা থেকে আমাদের অনেককেই শুনতে হয়েছে তোমাকে দিয়ে এটা হবে না। তুমি এটা পারবে না। তোমার মাথায় বুদ্ধি নেই, কিংবা তুমি কিছু শিখতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আমাদের মধ্যে অনেকেই সেই কথাগুলোকে ধ্রুব সত্য ভেবে নিয়ে নিজেকে বার বার বলে এসেছে সত্যিই আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। আমার মাথায় অন্যের মত বুদ্ধি নেই। আসলে কি বিষয়টা তাই? না আসলে এটা সত্য নয়। মস্তিক আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উদ্দীপনা আর আমাদের কাজেরই ফল। মস্তিক অনেকটা প্লাস্টিকের মতো। আমরা চাইলে একে আমাদের মন মতো যেকোনো রূপ দিতে পারি। যেকোনো বয়সে মস্তিষ্কের পরিবর্তন হয়ে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে বলা হয় ব্রেইন প্লাস্টিসিটি। আমাদের মস্তিষ্ক শত শত কোটি নিউরন দিয়ে গঠিত। আর এই নিউরনগুলো একে-অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে, যার ফলে আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারি। আমাদের মস্তিষ্কে যে ‘নিউরোনাল সংযোগ’ রয়েছে, প্রতিনিয়ত তার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পুনর্গঠন চলতে থাকে। এই প্রক্রিয়াকে বলে নিউরোপ্লাস্টিসিটি।
আগে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মনে করতেন, এই নিউরোপ্লাস্টিসিটির বিকাশ ঘটে শুধু শৈশবে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, এর অনেক কিছু প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়ও ঘটে থাকে। কেউ যদি দীর্ঘদিন যাবৎ মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন, তাহলে এই নিউরোপ্লাস্টিসিটি ব্যাহত হয়।
যেকোনো কিছু শিখতে এবং নতুন অভ্যাস গঠন করতে সাহায্য করে নিউরোপ্লাস্টিসিটি। আমরা যখন নতুন কিছু শিখতে যাই, তখন আমাদের মস্তিষ্কে বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদানের ক্ষরণ হয় এবং মস্তিষ্কে একটি সাময়িক পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে সেটা শর্ট টার্ম মেমোরিতে পরিণত হয়। আবার সেটিকে বারবার পুনরাবৃত্তি করলে, নতুন নিউরাল কানেকশন তৈরি হয়ে মস্তিষ্কে স্থায়ী পরিবর্তন সাধন করে সেটা লং টার্ম মেমরিতে পরিণত হয়। তাই কোনোকিছু শিখতে চাইলে বা নতুন অভ্যাস গঠন করতে চাইলে, আমাদের বেশি করে সেটি অনুশীলন করতে হয়। এটি আমাদের খারাপ অভ্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা যদি দীর্ঘদিন ধরে কোনো অনিয়ম করে থাকি, খারাপ কোনো কাজ করে থাকি বা মাদক গ্রহণ করে থাকি, তবে তার জন্যও আমাদের মস্তিষ্কে পরিবর্তন সাধিত হয় এবং নেতিবাচক প্লাস্টিসিটি তৈরি হয়।
নিউরোপ্লাস্টিসিটির দ্বারা আমরা চাইলেই আমাদের মস্তিষ্ককে আমাদের নিজের মতো করে গড়ে নিতে পারি। এজন্য প্রয়োজন শুধু চর্চা করা। আমাদের মস্তিষ্ক কেমন হবে, তা সম্পূর্ণ আমাদের কাজের উপর নির্ভর করে। আমরা যদি আমাদের দৈনন্দিন স্বভাবের উপর একে ছেড়ে দিই, তবে তা আমাদের দৈনন্দিন স্বভাবগুলো নিয়েই বেড়ে উঠবে। আবার আমরা চাইলেই আমাদের মনমতো একটি মস্তিষ্ক গড়ে তুলতে পারি। নিউরোপ্লাস্টিসিটি বজায় রাখার জন্য আমাদের কোনো না কোনো কাজের মধ্যে থাকা জরুরি। সে জন্য কিছু অভ্যাস গড়ে তোলা খুবই জরুরি।
১. নতুন কিছু শেখা :-
গবেষণায় জানা গিয়েছে, আমরা যতদিন নতুন নতুন জিনিস শিখতে থাকি, ততদিন আমাদের মস্তিষ্কও পরিবর্তন হতে থাকে। যেমন:-ভিন্ন ভাষা শেখা,ছবি আঁকা, সাঁতার, সাইকেল চালানো, গাড়ি চালানো, নাচ, গান শেখা, মিউজিক তৈরি করা ইত্যাদি নিউরোপ্লাস্টিসিটি এবং মস্তিষ্কের উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
২. শারীরিক ব্যায়াম :-
প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মিনিটের ব্যায়াম নিউরোপ্লাস্টিসিটিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শারীরিক ব্যায়াম বিভিন্ন ব্রেইন কেমিক্যালের মাত্রা বৃদ্ধি করে যা নতুন নিউরন ও নিউরাল কানেকশন গঠনে সাহায্য করে এবং সিন্যাপ্স কানেকশনগুলো মুছে যাওয়া থেকে রোধ করে। হাঁটা চলাও শরীরের পক্ষে একটি সহজ ও কার্যকর ব্যায়াম। এটি নিউরন কানেকশনগুলোকে তরতাজা রাখে।
৩.পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ :-
পুষ্টিকর উপাদান আমাদের নিউরন এবং নিউরোট্রান্সমিটার গড়তে সাহায্য করে, সেগুলো নিয়মিত খাওয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিউরোপ্লাস্টিসিটি বৃদ্ধি করতে পারি। যেমন-ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, বিশেষ করে DHA (docosahexaenoic acid), মস্তিষ্কের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, ভিটামিন-ডি এবং ভিটামিন-ই,ডার্ক চকলেট, বাদাম,তেলের বীজ,মাছ বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ,ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থিওনেট ইত্যাদি।
৪.পর্যাপ্ত ঘুম :-
দৈনিক পাঁচ ঘন্টার কম ঘুম হলে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে।আর দশ ঘন্টার বেশি ঘুম হলে মস্তিষ্ক সজাগ হওয়ার সময় পায় না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। নিউরোপ্লাস্টিসিটির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ঘুম বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।
৫. মেডিটেশন :-
মস্তিষ্ককে শান্ত রাখা একটি যথেষ্ট কঠিন কাজ। গবেষণা থেকে জানা যায়, মেডিটেশনের সময় মস্তিষ্ক এমন কিছু কেমিক্যাল ক্ষরণ করে যা মস্তিষ্কের কোষ বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে, মনোযোগ বৃদ্ধি করে, নিউরাল কানেকশনগুলোকে শক্তিশালী করে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের উন্নতিসাধনে মেডিটেশন যথেষ্ট গুরুত্ববাহী।
জেনে নাও : বাড়িতে অবসাদ মুক্ত থাকতে করণীয় ৮ টি বিষয়
৬. সু-অভ্যাস গড়ে তোলা :-
আমরা প্রত্যেকেই চাই আমাদের খারাপ অভ্যাসগুলো মুছে ফেলে সু-অভ্যাস গড়ে তুলতে। কিন্তু ব্যাপারটা অতটাও সহজ নয়। আমরা চাইলেই আমাদের অভ্যাসগুলোকে বদলে দিতে পারি না। আমাদের খারাপ অভ্যাসগুলোও নিউরোপ্লাস্টিসিটিরই ফসল। কিন্তু দুটি সহজ উপায় অবলম্বন করে সহজেই আমরা নতুন সু-অভ্যাস গড়ে ফেলতে পারি আমাদের সুপার পাওয়ার নিউরোপ্লাস্টিসিটি ব্যবহার করে। যেকোন নুতন অভ্যাস বা সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে হলে ছোট ছোট পদক্ষেপ দিয়ে শুরু করা। যখন আপনি অভ্যাসটি তৈরি করতে থাকবেন, চেইন ব্রেক করবেন না। প্রতিদিন চেষ্টা করতে হবে কাজটি একটু হলেও করার। এতে করে নতুন সিন্যাপ্স কানেকশন তৈরি হবে এবং ধীরে ধীরে আমরা কাজটিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবো।
৭. নেতিবাচক চিন্তা পরিহার :-
যেকোন ঘটনার দুটি দিক থাকে একটি ইতিবাচক অন্যটি নেতিবাচক। কিন্তু দেখা যায় আমরা বেশির ভাগ সময় নেতিবাচক চিন্তা ও ধারণাগুলোকে লালন-পালন করে বেড়াই। আর এটা নিউরোপ্লাস্টিসিটির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার নেতিবাচক দিকের ওপর মনোযোগ না দিয়ে, বরং সেই ঘটনা থেকে আমরা কী কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি,তা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। সেখানে যদি কোনো অর্জন থাকে, তা যত ছোটই হোক না কেন, সেটির জন্য নিজেদের পুরস্কৃত করা প্রয়োজন। এর ফলে আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বাড়বে।
৮. বই পড়া ও লেখালেখি :-
বই মানুষের প্রকৃত বন্ধু ব’লে নিউরনের ক্ষেত্রেও সেই বন্ধুত্বের ভূমিকাই পালন করে বই। তাই সময় করে প্রতিদিন কিছুটা সময় অন্তত বই পড়ুন। বই পড়া ও লেখালেখির মাধ্যমে মস্তিষ্কে নিউরনের সংযোগ পুনর্গঠিত হয়ে ওঠে; আজ একথা প্রমানিত সত্য।
৯. খুশি থাকুন :-
একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবন গঠনে নিউরোপ্লাস্টিসিটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। যেহেতু আমাদের বুদ্ধিমত্তা বদলাতে পারে, তার সাথে সাথে আমরা আমাদের আবেগ এবং অন্যান্য অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমরা চাইলেই খুশি থাকা শিখতে পারি। রোজ এমন তিনটি বিষয় বা ঘটনা লেখা জরুরি যার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কাউকে ইতিবাচক কিছু বলুন বা লিখে পাঠান। বিগত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি লিখুন। ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে খুশি খুঁজুন। এতে আপনার মন ও মস্তিষ্কের উন্নয়ন ঘটবে।
১০. মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা :-
মানসিক চাপ বিষয়টি আজ খুব পরিচিত বিষয়। দীর্ঘদিন ধ’রে মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে নিউরোপ্লাস্টিসিটি প্রতিহত হতে থাকে । তাই মানসিক চাপের সঠিক নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে সচল রাখুন এবং জীবনকে সুন্দর ও উপভোগ্য করে গড়ে তুলুন। মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনার অনেক ধরনের উপায় রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নিজেকে সময় দেওয়া। প্রতিদিন নিয়ম করে অন্ততপক্ষে পাঁচ মিনিট হলেও নিজেকে সময় দিন। নিজের পছন্দের কাজগুলি না করতে পারার ফলেই মানসিক চাপের জন্ম হয়। সেই সময়টাতে নিজের পছন্দের কাজগুলি মন খুলে করতে থাকুন আর জীবনের জরা ব্যাধিকে দূরে রেখে হয়ে উঠুন চিরসবুজ।
নিউরোপ্লাস্টিসিটি নিয়ে আমাদের লেখাটি কেমন লাগলো তা আমাদের কমেন্টে জানান। ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন । এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলের সাথে যুক্ত থাকুন।