হরমোন কী ? হরমোনের কাজ, মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন নিয়ন্ত্রণে হরমোনের ভুমিকা
মানুষের জীবনে প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু জৈবনিক উপাদানের বড় ভূমিকা থাকে । যার মধ্যে অন্যতম হল হরমোন । তাই আজ আমরা এই হরমোন বিষয়ে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করবো।
হরমোন কী ?
মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হরমোন শরীরে কাজ করে। হরমোন ছাড়া আমরা প্রাণবন্ত থাকতে পারব না। হরমোন কথার অর্থ হল ‘জাগ্রত করা’বা ‘উত্তেজিত করা’। হরমোন প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯০২ সালে। সেটি ছিল সিক্রেটিন হরমোন। ১৯০৫ সালের জুন মাসে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের শরীরবিদ্যার অধ্যাপক আরনেস্ট স্টারলিং সর্বপ্রথম ‘হরমোন’ শব্দটি তার লেকচারে ব্যবহার করেন। গ্রিক ‘hormōn’ শব্দ থেকেই এই শব্দের উৎপত্তি।
হরমোন হলো আমাদের শরীরে থাকা এক রাসায়নিক দূত। আমাদের দেহের নির্দিষ্ট কিছু অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোতে তৈরি হয় এই হরমোন। এই অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলো তাদের নিজেদের মধ্যেই হরমোন তৈরি করে রক্তে নিঃসরণ করে। রক্তের মাধ্যমেই হরমোন পরিবাহিত হয়ে উৎপত্তিস্থল থেকে অনেক দূরেও তার কাজটি করতে পারে। হরমোনের তারতম্যের প্রভাবে শরীরে নানারকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, হরমোন শুধু শারীরিক বিকাশ ঘটায় না, আমাদের আচরণ ও অনুভূতিও হরমোনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের ভালো লাগা, ভালোবাসা, উত্তেজনা কিংবা মন খারাপের জন্যও দায়ী অনেক হরমোন। ডোপামিন, সেরাটোনিন আর অক্সিটোসিন এর মধ্যে অন্যতম। প্রতিটি মানুষের মধ্যে হরমোনের মাত্রা আলাদা। যার কারণে প্রতিটি মানুষের আচরণ একে অপরের থেকে বেশ আলাদা দেখা যায়। এবার আলোচনা করবো যে হরমোনগুলো মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে সেই সম্পর্কে।
ডোপামিন হরমোন :-
ডোপামিন হল একটি হরমোন এবং ক্যাটেকোলামাইন ও ফেনাথ্যালামিন পরিবারের একটি নিউরো ট্রান্সমিটার। যা মানব মস্তিষ্ক ও শরীরে বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিকভাবেই এটি মানব শরীরে উৎপন্ন হয়। আমাদের সার্বিক মুড(mood) বা মনের ভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে ডোপামিন। ডোপামিন মোটিভেশন, মনঃসংযোগ, ইমপালসিভিটি বাড়ায়। আবেগ বা উত্তেজনায় আমরা কিভাবে সাড়া দেব, তাও ডোপামিন নিয়ন্ত্রণ করে। ডোপামিনকে কখনো ‘feel-good’ হরমোন বলা হয়। কোনো কাজের প্রত্যাশামাফিক ফল পাওয়ার পরে আমাদের যে চরম আনন্দের অনুভূতি হয় তার জন্য দায়ী ডোপামিন। কোনো কাজে সফলতা অর্জনের পরে এই ডোপামিন নিঃসরণ অনেকটা মানসিক পুরষ্কারের মতোই কাজ করে। ডোপামিনেরই অনুপ্রেরণায় আমরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেকে নিযুক্ত করতে পারি। মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কম হলে সেই ব্যক্তি নিদ্রাহীনতা, অবসাদ বা পার্কিনসন্স ডিজিজে ভুগতে পারেন। আবার অপরদিকে ডোপামিন দরকারি মাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা স্কিটজোফ্রেনিয়ার মত কঠিন মানসিক ব্যাধির কারণ হতে পারে।
অক্সিটোসিন হরমোন :-
‘Love hormone’ হিসেবে পরিচিত অক্সিটোসিন হরমোনটি প্রেমে পড়া এবং শরীরে ভালোবাসার শিহরণ জাগিয়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই হরমোন মানুষের মনকে খুশি রাখে। শরীরে বিভিন্ন ইতিবাচক লক্ষণ ফুটে ওঠে এই হরমোনের প্রভাবেই। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত অক্সিটোসিন হরমোনের কারণেই মানুষের মনে প্রেম, কামনা, বাসনা, আবেগ ইত্যাদি ক্রিয়াশীল হয়। সন্তান এবং বাবা-মায়ের মধ্যে বন্ধন তৈরি করে এই হরমোন। বন্ধন তৈরি করে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গেও। শরীর ও মনে ইতিবাচক অনুভূতি আনতেও এই হরমোন বিশেষ ভূমিকা পালন করে । মানে এক কথায় অক্সিটোসিন হল মানুষকে সুখী রাখার একটি দারুণ মাধ্যম। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় শেষের পর্যায়ে জরায়ুর সংকোচন ঘটিয়ে সন্তান প্রসবের সহায়তা করে এবং স্তনগ্রন্থের বৃদ্ধি ও দুগ্ধ নিঃসরণে এর ভূমিকা রয়েছে। প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটালে ও অপরের প্রতি সদয় হলে শরীরে অক্সিটোসিন বাড়ে।
Read More : খেজুরের উপকারিতা ও অপকারিতা
সেরোটোনিন হরমোন : –
সেরোটোনিন বা ৫-হাইড্রক্সিট্রিপ্টামিন হল মস্তিষ্কের স্নায়ুকে সংযোগকারী একটি নিউরোট্রান্সমিটার। রক্তনালিকায় রক্ত প্রবাহে এটি সাহায্য করে। এটি হরমোন নয়, এটি একটি মনোএমাইন। অনেক উদ্ভিদ এবং ছত্রাকে সেরোটোনিন পাওয়া যায়। মস্তিষ্কে এটি একরকম কাজ করে, শরীরের অন্য জায়গায় আরেক কাজ করে। প্রধান কাজ অন্ত্রে, বাকি কাজ মস্তিষ্কে। সেরোটোনিনের প্রধান কাজ সমূহের একটি হচ্ছে পরিপাকে সাহায্য করা। এটি মানুষের ক্ষেত্রে ভাল থাকার অনুভূতি প্রদান করে। তাই একে অনেকসময় সুখানুভূতির হরমোন বলা হয়। সেরোটোনিন মানুষের মধ্যে আবেগ, আনন্দ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি চিন্তা, মানসিক ক্লান্তি কমায়। এছাড়া পড়াশোনা, স্মৃতিশক্তির সঙ্গেও এই হরমোনটির নাম জড়িত। এই হরমোন আমাদের মনকে শান্ত রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেরোটোনিনের নেতিবাচক প্রভাব খুব বেশি। সেরোটোনিনের মাত্রার হেরফের হলে হাল ছেড়ে দেওয়া, অপরাধবোধে ভোগা, আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয় । মস্তিষ্কে বেশি মাত্রায় সেরোটোনিন বেড়ে গেলে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যায়। প্রাকৃতিক উপায়ে সেরোটোনিন বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো, প্রতিদিন শরীরচর্চা করা।
ইস্ট্রোজেন হরমোন :-
ইস্ট্রোজেন হরমোন হল মহিলাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হরমোন। নারী ও পুরুষ উভয়ের শরীরেই এই হরমোন থাকলেও নারীদের প্রজনন বয়সে এটি উচ্চমাত্রায় থাকে। তাই ইস্ট্রোজেনকে বলা হয় ‘নারী হরমোন’। মূলত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন এই দুই হরমোন মহিলাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। তাই এই দুই হরমোনের মাত্রার তারতম্য ঘটলে নানা সমস্যা দেখা যায়। ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রেগন্যান্সি থেকে শুরু করে পিরিয়ডস, এমনকী কোলেস্টেরল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত করে। নারীর মেনোপজ (মাসিক চক্র স্থায়ীভাবে বন্ধ) হলে ইস্ট্রোজেন কমে যায়। যাদের মেনোপজ হতে যাচ্ছে তাদের ইস্ট্রোজেনও কমতে থাকে। একারণে এসময় নারীদের খিটখিটে আচরণ বেড়ে যায়। মহিলা ক্লান্ত বোধ করে, খিটেখিটে বা অধৈর্য হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত মাত্রায় ইস্ট্রোজেন হরমোন নিঃসরণের ফলে নারী শরীরে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, মুড সুইং, স্তনে ফিব্রোসিস্টিক লাম্প,ঘুমের সমস্যা, চুল পড়া, সারাক্ষণ ক্লান্ত লাগা,অনিয়মিত পিরিয়ডস ,যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, পিএমএস বা পিরিয়ড পূর্ববর্তী উপসর্গ বেড়ে যাওয়া, ইত্যাদি।
প্রোজেস্টেরন হরমোন :-
প্রোজেস্টেরন হচ্ছে এমন এক ধরনের যৌন (সেক্স) হরমোন যা রজঃচক্র, গর্ভধারণ ও ভ্রূণীয় বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মহিলাদের শরীরে প্রোজেস্টেরন হরমোন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রোজেস্টেরনের প্রধান কাজ হচ্ছে গর্ভাবস্থার জন্য জরায়ু প্রস্তুত করা। মহিলাদের স্তনের বিকাশের জন্য প্রজেস্টেরন হরমোন প্রয়োজনীয় স্তনে দুগ্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি গুলির বিকাশকে উৎসাহিত করে। এটি শরীরে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণও নিয়ন্ত্রণ করে। মহিলাদের শরীরে প্রোজেস্টেরন হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই হরমোন ভালোভাবে ঘুমাতে, দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা এড়াতে এবং মেজাজের আগ্রাসী ওঠানামা প্রতিরোধে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
Read More : রসুনের উপকারিতা কি কি । রসুন খাওয়ার সঠিক নিয়ম
টেস্টোস্টেরন হরমোন:-
টেস্টোস্টেরন হরমোন হল সেক্স হরমোন (Sex Hormone)। এই হরমোন নারী, পুরুষ উভয় শরীরেই থাকে। যদিও এই হরমোন পুরুষ শরীরেই বেশি থাকে। নারীর শরীরে এই হরমোন থাকে খুবই কম মাত্রায়। আর পুরুষের শরীরে এই হরমোন নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি পুরুষের প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্যগুলোর বিকাশে সাহায্য করে। এটি প্রধান পুরুষ হরমোন যা শুক্রাশয়ের লিডিগ কোষ (Leydig Cell) থেকে উৎপন্ন হয়। এবং বাকি ৫% টেস্টোস্টেরন অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন হয় । টেস্টোস্টেরন শরীরে কমে যাওয়ার কারণে অ্যান্ড্রোপজ হয়। পুরুষদের চুলের গঠন, পেশির গঠন, গলার আওয়াজ সবই নিয়ন্ত্রিত হয় টেস্টোস্টেরন হরমোনের দ্বারা। টেস্টোস্টেরন হরমোনের অভাবে পুরুষের যৌন চাহিদা কমে যাওয়া, মানসিক পরিবর্তন, বিষণ্ণতা, বাড়তি ওজন, অবসাদ, ঘুমের সমস্যা, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
মেডিক্যাল সাইন্স এর ভাষায় যাই বলুক না কেন , আমরা সাধারণ বুদ্ধিতেও এই হরমোনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি । হরমোনবিদ্যা বা এন্ডোক্রিনোলোজি আজ অনেক উন্নততর গবেষণায় মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য হরমোন এর কার্যকলাপের উপর আলোকপাত করেছে । তাই বলা হয় মানুষ যদি আচরণ,খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দ্বারা হরমোনের ভূমিকাকে বুঝতে পারে তবে জীবনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা যাবে সহজেই।
তাহলে বন্ধুরা , আশা করি আজ হরমোন কী , হরমোনের কাজ, মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন নিয়ন্ত্রণে হরমোনের ভূমিকার কথা ভালোভাবে জানতে পারলাম । লেখাটি ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই বন্ধুদের শেয়ার করবেন । এরকম আরো আর্টিক্যাল পড়তে আমাদের ফেসবুক পেজটি লাইক করে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান ।