শরীর ও স্বাস্থ্য

মাইগ্রেন কী ? আপনি মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন না তো ? জেনে নিন মাইগ্রেনের ব্যথা দূর করার ঘরোয়া কিছু উপায়

4 Minute Read

“আধ-কপালি ” কিংবা ‘আধ-কপাল ব্যথা’ কথাটি শুনেছেন ? গ্রামদেশে শব্দটি পরিচিত হলেও ডাক্তারি ভাষায় এর নামটি হল মাইগ্রেন। সাধারণভাবে মাথাব্যথা অনেক প্রকার হতে পারে । তারমধ্যে একপ্রকার হল মাইগ্রেন । এই সমস্যাটি কিন্তু বেশি দিন আগে ধরা পরে নি । আনুমানিক ২০ বছর ধরে মাইগ্রেন বিষয়টি চিকিৎসকদের নজরে আসে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় গ্রমের মানুষের থেকে শহরের মানুষের মধ্যে এই মাইগ্রেনের প্রকোপ অনেক বেশি । বিশেষ করে জনবহুল, ধুলোবালিযুক্ত ও দূষিত পরিবেশে এই মাইগ্রেনের প্রকোপ একটু বেশি লক্ষ্য করা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে মাইগ্রেনের সর্বসম্মতভাবে নিশ্চিত ব্যখ্যা এখনো দেওয়া যায় নি । তবে মূল যে বিষয়টি তারা স্বীকার করেন তা হল , মাইগ্রেন একধরণে নিউরোভাস্কুলার ডিজঅর্ডার এবং এই ধারণার কারণ এই সমস্যা মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয় এবং তারপর ধীর ধীরে রক্তশিরায় ছড়িয়ে যায়।

“মাইগ্রেন ” শব্দটির উৎসঃ-

“মাইগ্রেন ” শব্দটির উৎস হল গ্রিক শব্দ ‘হেমিক্রানিয়া’ । যার অর্থ “মাথার একদিকে ব্যথা” ( হেমি-=অর্ধেক”, ক্রানিয়ন= “খুলি”) । — এই হেমিক্রানিয়া থেকেই মাইগ্রেন (Migraine) কথাটির সৃষ্টি হয়।

মাইগ্রেন কাদের হয় :-

গবেষণায় দেখা গেছে ১০ বছর থেকে ৪৫ বছরের মানুষের মধ্যেই সাধারণভাবে মাইগ্রেন এর সমস্যা হয়ে থাকে । পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পুরুষ মানুষের থেকে নারীদের মধ্যে মাইগ্রেনের সমস্যা বেশি দেখা যায় । আর গ্রাম বা জনবিরল এলাকার মানুষের থেকে শহর বা জনবহুল এলাকার মানুষের মধ্যে মাইগ্রেনের সমস্যা বেশি হয় ।

মাইগ্রেনের কারণ :-

চিকিৎসা বিজ্ঞান আজও মাইগ্রেনের সঠিক কারণ আবিষ্কার করতেই পারে নি । কিন্তু উপসর্গভিত্তিক গবেষণা থেকে এর কারণ সম্পর্কে কিছু কিছু সাধারণ বিষয় উঠে এসেছে । সেগুলি হলঃ-


১। অতিরিক্ত চিন্তা
২। কোলাহল
৩। তীব্র আলো
৪। উচ্চ শব্দ
৫। ধুলোবালি বা ধোঁয়া
৬। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বা প্রচণ্ড গরম
৭। ঘুম না হওয়া
৮। কিছু ওষুধের সাইড ইফেক্ট
৯। কিছু কিছু খাবার ( নীচে তালিকা দেওয়া আছে)
১০। আরাম বিরামহীন জার্নি ইত্যাদি ।

যে খাবারগুলি মাইগ্রেনের ব্যথাকে বাড়িয়ে দেয় :-

কোনো কোনো খাবার মাইগ্রেনের ব্যথাকে বাড়িয়ে দেয় বলে অনেক ডাক্তার অভিমত প্রকাশ করেছেন। সেগুলি যেমনঃ- পনির, চকোলেট, নানা মাদকদ্রব্য, ঠাণ্ডা পানীয় ইত্যাদি।

যে পরিবেশ মাইগ্রেনের ব্যথাকে বাড়িয়ে দেয় :-

প্রচন্ড গরম বা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা , কিংবা ভ্যাপসা জলীয় বাষ্পে ভরা পরিবেশ শীতকালের ঠান্ডা বাতাস বা কুয়াশা ইত্যাদি মাইগ্রেনের রোগীর মাথাব্যথার প্রকোপ বাড়িয়ে দিতে পারে। এছারাও ভীরের কোলাহল, শব্দ , তীব্র আলো মাইগ্রেন রুগীর পক্ষে ক্ষতির কারন হয়ে থাকে । উত্তেজনাপূর্ণ খবর , বা হৃদয়ে আঘাত থেকেও মাইগ্রেনের সৃষ্টি হয়ে থাকে বলে ডাক্তারদের অনুমান।

মাইগ্রেনের লক্ষণ :-

মাইগ্রেনের লক্ষণকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা-
পূর্ব লক্ষণ ও পরবর্তী লক্ষণ ।

পূর্ব লক্ষণঃ-

মাইগ্রেন শুরু হবার আগে কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যায় বটে । তবে বেশিরভাগ মানুষ সেগুলি বুঝে উঠতেই পারেন না । বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বিভিন্ন পূর্ব লক্ষণ দেখা যায় । সেগুলি যেমন –

১। ঝিমুনি
২। বমি বমি ভাব
৩। উৎসাহহীনতা
৪। খিটখিটে মেজাজ
৫। হাই ওঠা
৬। ক্ষুধামন্দা
৭। অতিরিক্ত পিপাসা ইত্যাদি ।

মাইগ্রেনের পরবর্তী লক্ষণ :-

মাইগ্রেনের পরবর্তী লক্ষন বলতে বোঝায় মাইগ্রেন শুরু হলে যে লক্ষণগুলি দেখা যায় । সেগুলি ব্যক্তিভেদে আলাদা হলেও , কমন যেটি সেটি হল মাথাব্যথা। পূর্ব লক্ষণগুলির সঙ্গে এছাড়া যে লক্ষ্মণগুলি লক্ষ করা যায় সেগুলি হল :

১। কপালের অর্ধেক দিক ব্যথা
২। মাইগ্রেনের ব্যথা চোখের পেছনে কিংবা ঘাড়ে, কখনো মাথার পেছনে – হতে পারে।
৩। অর্ধেক মাথায় ব্যথা
৪। বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া
৫। বেশি আলো বা বেশি শব্দ অসহ্য লাগা
৬। কথা বলতে অসুবিধা
৭। ক্লান্তি ও অবসন্নতা
৮। ক্ষুধা মন্দা
৯। অতিরিক্ত ঘাম ইত্যাদি ।

মাইগ্রেনের প্রকারভেদ :-

মাইগ্রেন সাধারণভাবে তিন প্রকার হয়। যথা- ক্লাসিক মাইগ্রেন , কমন মাইগ্রেন ও অ্যাটিপিক্যাল মাইগ্রেন। ক্লাসিক মাইগ্রেন হল পূর্ব থেকেই আন্দাজ করা যায় এমন মাইগ্রেন।

মাইগ্রেন প্রতিরোধে কিছু ঘরোয়া টিপস :-

১. তাজা আঙুরের রস( জল না মিশিয়ে) খেলে মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়৷
২.একটা ভেজা গামছা বা তোয়ালে ৪-৫ মিনিট ফ্রিজে রেখে তারপর ওই ঠান্ডা গামছকে মাথায় ও চোখের উপর কিছুক্ষণ রাখলে ব্যথা থেকে আরাম পাওয়া যেতে পারে।
৩. চন্দনকাঠের গুঁড়ো ও অল্প জল মিশিয়ে একটি পেস্ট বানান আর পেস্টটি কপালে মেখে নিন৷ এতে মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে আরাম পাওয়া যায়।
৪. কোনো অন্ধকার নির্জন ঘরে চোখ বুঁজে শুয়ে থাকলে প্রতিনিয়ত মাথা ব্যথা থেকে অনেকটাই আরাম মিলবে।
৫. মাথা ম্যাসাজ করালেও মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়৷
৬. লেবুর রস আর লবন দিয়ে তৈরি শরবৎ খেলে মাইগ্রেনের ব্যথা দ্রুত কমে যায় বলে অনেকেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে ।


যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে মাইগ্রেনের ব্যথা কমান :-

অনেকেই যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে মাইগ্রেন এর সমস্যা থেকে দূরে থাকেন । তাঁরা বিশ্বাস করেন যোগ ব্যায়ামের ফলে মাইগ্রেইনের আক্রমণের হার যেমন কমায় তেমনি এর যন্ত্রণা ও কমিয়ে আরাম দিতে পারে। এটা প্রমাণিত সত্য যে যোগের মাধ্যমে টেনশন বা মানসিক চাপ কমানো যায়। তাই বলা হয় যোগের মাধ্যমে মাইগ্রেনের সমস্যাও দূরে রাখা সম্ভব । অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ধারণা অনুসারে বলা যায় মাইগ্রেনের জন্যে কিছু নির্দিষ্ট যোগাসনের নাম , যেমন — চক্রাসন, অর্ধ-চক্রাসন , অর্ধ-মৎসেন্দ্রাসন ইত্যাদি। এছাড়াও সাতক্রিয়া, কপালভাতি এবং কিছু প্রাণায়ামের প্রক্রিয়া রয়েছে । নিয়মিত ধ্যান করার মাধ্যমেও মাইগ্রেনকে দূরে রাখা সম্ভব।

প্রচলিত চিকিৎসা :-

১.আপনার মাইগ্রেনের সমস্যা তৈরি হলে অনুমান করে মাথাব্যথার ট্যাবলেট না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন ।
২. যে সব খাবার (উপরে বর্ণিত হয়েছে) মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়িয়ে দেয় সেসব খাবার এড়িয়ে চলুন।
৩. মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাবার ফলে মাইগ্রেনের ব্যথা হয়ে থাকলে, সেই বড়ি খাওয়া বন্ধ করে দেখুন মাইগ্রেনের এর সমস্যা কমছে কিনা। পারলে বিকল্প পদ্ধতি আশ্রয় নিতে পারেন ।
৪. ধোঁয়া বা ধুলাবালি বা প্রচন্ড গরম বা শীতের বাতাসের মাঝে বের হতে হলে তবে মাস্ক বা রুমাল ব্যবহার করার অভ্যাস তৈরি করুন ।
৫. সর্বোপরি বলতেই হয় যে কোনো রোগের বা সমস্যার জন্য যেমন তাদের কারণটি বের করে সেগুলি থেকে দূরে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ । তেমনি উপরে বর্ণিত মাইগ্রেনের কারণগুলো থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করুন ।

ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা:-

সাধারণভাবে ডাক্তারেরা যেসব অসুধগুলি মাইগ্রেনের জন্য দিয়ে থাকেন সেগুলি নীচে দেওয়া হল । মনে রাখবেন এগুলি কীভাবে কতটা পরিমানে খাবেন তা অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে খাবেন।

১. ট্যাবলেট অ্যাসপিরিন (600–900mg) যা জলে দ্রবণীয় কিংবা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট (পরিমাণমত)
২.খুব বমি হলে বমি বন্ধ করার জন্য ওষুধ, যেমন- Metoclopromide(মেটোক্লোপ্রোমাইড) বাজারে যা মোটিলন, নিউট্রামিড ইত্যাদি নামে পরিচিত অথবা প্রোক্লোরপিরাজিন ((prochlorperazine)) বাজারে যা স্টিমিটিল, ভারগন বা প্রম্যাট নামে পাওয়া যায়- এসব চিকিৎসকেরা দিয়ে থাকেন ।
৩. সর্বোপরি মনে রাখবেন আপনার অভিজ্ঞতাকে যেন ডাক্তারের সুপরামর্শ শুনে তারপর প্রয়োগ করবেন । আর জানবেন দেশ কাল বয়স ওজন অনুযায়ী ওষুধ আলাদা আলাদা হয়ে থাকে ।

আশা করি বন্ধুরা আজকের বিষয়টি কিছুটা হলেও জীবনে কাজে লাগবে । এরকম আরো নানা আর্টিক্যাল পড়তে আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক করে সঙ্গে থাকুন । ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন । আপনাদের সঙ্গে প্রেরণাজীবন সবসময় থাকবে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *