শরীর ও স্বাস্থ্য

ইম্পোস্টার সিনড্রোম কী ? আপনি এই সমস্যায় ভুগছেন না তো ?

4 Minute Read

ইম্পোস্টার সিনড্রোম কী ? আপনি এই সমস্যায় ভুগছেন না তো ?

আপনি কি আপনার পাওয়া সব অর্জনগুলোকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন এবং নিজেকে ঐ সব অর্জনের জন্য অযোগ্য বলে মনে করছেন ? আপনার অর্জনের পেছনে আপনার পরিশ্রম , আপনার মেধাকে বড় করে না দেখে আপনি কি সর্বদা ভাগ্যেরই জয়গান গাইতে থাকেন, আর এই কারণেই নিজেকে একজন প্রতারক বা ছলনাকারী বলে মনে হয় আপনার ? আপনার কি সর্বদা মনে হয় কেউ আপনার মুখোশ টা খুলে দেবে , আপনার আসল পরিচয় টা সকলের সামনে বের করে আনবে ? যদি সর্বদা এই অনুভূতিগুলি আপনাকে ঘিরে রাখে, তাহলে আশঙ্কা রয়েছে আপনি ইম্পোস্টার সিনড্রোম এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।

ইম্পোস্টার সিনড্রোম কী ?

ইম্পোস্টার (Imposter) মানে হল ছদ্মবেশী, ভন্ড ও প্রতারক। আর সিনড্রোম (Syndrome) মানে হল লক্ষণ। অর্থাৎ ইম্পোস্টার সিনড্রোম হল এমন এক ধরণের মানসিক অবস্থা যেখানে মানুষ তার নিজের অর্জন , সাফল্য, যোগ্যতা ও খ্যাতিকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং নিজেকে অযোগ্য বলে মনে করে। এবং তার মনে হতে থাকে নিছকই ভাগ্যগুনে সে এখানে অবস্থান করছে। এবং সে যে যোগ্য নয় এই বিষয়টি সকলের সামনে ক্রমশ প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে বা যাবে। এই মানসিক অবস্থার নাম ইম্পোস্টার সিনড্রোম

১৯৭৮ সালে Dr. Pauline R. Clance এবং Dr. Suzanne A. Imes তাঁদের প্রবন্ধে (The Impostor Phenomenon in High Achieving Women: Dynamics and Therapeutic Intervention)

ইম্পোস্টার সিনড্রোম নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন, অনেক সাফল্য পাওয়া নারীদের মধ্যে এটি দেখা যায়। তাঁরা মূলত সেসব নারীদের নিয়েই গবেষণা করেন।

পরে অবশ্য, বিভিন্ন রিসার্চ থেকে জানা যায় যে, শুধুমাত্র নারী না, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই ইম্পোস্টার সিনড্রোমের মধ্যে দিয়ে যায়।

“দ্য সিক্রেট থটস অব সাক্সেসফুল উইমেন’ বইয়ের লেখক ভ্যালেরি ইয়াং একজন ইম্পোস্টার সিনড্রোম বিশেষজ্ঞ। ইম্পোস্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আচরণে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য তিনি খুঁজে পেয়েছেন:

১.পারফেকশনিস্ট : (The Perfectionist)

পারফেকশনিস্ট মানুষজন তাদের কাজেকর্মে সবকিছুতেই নিঁখুত হতে চেষ্টা করেন। ৯৯% শতাংশ সফল হলেও তারা নিজেকে ব্যর্থ মনে করেন। এবং নিজেদের দোষারোপ করে তাদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে সন্দিহান প্রকাশ করতে থাকেন। কারণ ১০০% পারফেকশন না থাকলে সেই সাফল্যকে তারা সাফল্য হিসেবে মানতে চান না।

২.সহজাত প্রতিভাবান(The Natural Genius ) :

কিছু মানুষ আছে যারা জন্ম থেকেই প্রতিভাবান। এমন ন্যাচারালি জিনিয়াস মানুষজনের মধ্যে মাঝে মাঝে একটা ধারণা জন্মায় যে, কোনো কাজ তারা একবারের চেষ্টাতেই পারবেন। কোনো কাজে তাদের বেশি পরিশ্রম দিতে হবে না। কিন্তু কোনো কাজে তারা যদি সেটা করতে না পারেন বা অন্য কথায়, যদি তারা কোনও কিছু আয়ত্ত করতে দীর্ঘ সময় নেয় তবে তারা লজ্জা বোধ করেন । তাহলে তাদের মধ্যে ইম্পোস্টার সিনড্রোম দেখা দেয়।

৩. সুপারম্যান বা সুপারওম্যান: ( The Superman/Superwoman)

এই টাইপের ব্যক্তিরা নিজেদেরকে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই সফল দেখতে বদ্ধপরিকর। আশেপাশের মানুষদের থেকে তারা সর্বদা একধাপ বেশি পরিশ্রম করতে চান শুধু এ কারণে যে তাদেরকে প্রমাণ করতেই হবে, তারা অযোগ্য নন। একজন ইম্পোস্টার নই আমি- শুধু এ ধারণাটি প্রতীয়মান করার জন্য তারা সবসময় নিজেদের উপর চাপ তৈরি করতে থাকেন।

৪. The Soloist: (একাকী মননের ব্যক্তি)

“আমার কারো সাহায্যের দরকার নেই আমি সব নিজেই করতে পারবো।”এই ধরণের স্বাধীনচিন্তা থাকা ভালো। পরনির্ভর না হয়ে নিজের প্রতি দায়িত্ব নেওয়া। কিন্তু যদি কেউ সর্বদা অন্যের সাহায্যকে প্রত্যাখ্যান করে সর্বদা একলা চলো নীতিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন এইভেবে যে, কারো কাছে সাহায্য চাইলে তাকে অন্যেরা প্রতারক বা ব্যর্থ মনে করতে পারে। এই ভয়ে সে নিজেকে সাহায্য চাওয়া থেকে বঞ্চিত রাখেন তবে বিষয়টি ইম্পোস্টার সিনড্রোম এর ইঙ্গিত দেয়।

৫.বিশেষজ্ঞ (The Expert) :

বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা যেকোনো কাজে হাত দেওয়ার আগে সে সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। আর তারা মনে করেন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের সকল তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। কর্মক্ষেত্রে বা কোনো মিটিং চলাকালীন তারা কোনো রকম প্রশ্ন করেন না। কারণ তাদের ভেতর ভয় কাজ করে, তারা ভাবে যদি ঐ প্রশ্ন তাকে অন্যদের সামনে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয় বা সবাই তাকে বোকা মনে করেন

গবেষণায় জানা যায় ৭০শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো সময় ইম্পোস্টার সিনড্রোম এ ভোগেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বা নানান পেশার মানুষ যেমন মায়া অ্যাঞ্জেলো, মিশেল ওবামা ,অস্কার জয়ী অভিনেতা টম হাংকস
বা পেনেলোপ এই বিখ্যাত মানুষগুলোও এই ইম্পোস্টার সিনড্রোম এ ভুগেছেন।

মায়া অ্যাঞ্জেলো, পুরষ্কার প্রাপ্ত লেখক একবার তার ১১ তম বই প্রকাশের পরে বলেছিলেন যে প্রতিবার তিনি অন্য একটি লেখার জন্য নিজেকে ভাববেন: “আহ-ওহ, তারা এখন উপলব্ধি করবে। আমি প্রত্যেকের উপর একটি খেলা চালিয়েছি ।”

টম হাংকস এক রেডিও সাক্ষাতকারে বলেছেন-
“আমি কী করেছি সেটা বিষয় নয়। বিষয়টা হলো কিভাবে এখানে এলাম। যখন মনে হয় আসলে আমি একজন প্রতারক এবং এটিই সব কিছু নিয়ে যায় আমার কাছ থেকে।”

ইম্পোস্টার সিনড্রোম কাটিয়ে ওঠার কয়েকটি উপায় :

১. নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। আপনি একা নন। আপনার অনুভুতিগুলো প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন। আমাদের মধ্যে অনেকেই এই সমস্যার সম্মুখীন।

২.নিজের কাজকে নিজে স্বীকৃতি দিন। তাহলে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

৩.নিজের অর্জন ও যোগ্যতার একটি তালিকা তৈরি করুন। ভাগ্যই আপনার সব অর্জনের মূলে কিন্তু যখন কাগজে আপনার অর্জন গুলি লিখবেন তখন মনে হবে এ চিন্তা হাস্যকর।

৪.যারা পারফেকশনিস্ট তাদের একটা ভালো দিক হল যে, তারা কোনো কাজ অতি যত্ন সহকারে করতে চান এবং নিখুঁত করে তুলতে নিয়মিত পরিশ্রম করেন । কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে যে , এই কাজের জন্য একেবারে যন্ত্রের মতো অমানবিক ভাবে খাটলে চলবে না । রুটিনের বাঁধা ধরা নিয়মের বাইরে একটু রিলাক্স ভাবে কাজ করবে হবে । আর কাজে কোনো ভুল হলে নিজেকে ক্ষমা করতে হবে ।

৫. সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতাকেও মেনে নিতে শিখুন । কারণ সাফল্যের সিঁড়িই হল ব্যর্থতা ।

৬. নিজেকে নিজে মূল্যায়ণের আগে অন্যের ফিডব্যাক গ্রহণ করুন । কারণ অন্যের চোখে দেখা নিজেকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় ।

৭. সকলেই আলাদা আলাদা ক্ষমতা সম্পন্ন । তাই অন্যের সঙ্গে তুলনা না করে নিজের পূর্বের কাজের সঙ্গে বর্তমান কাজের দক্ষতার তুলনা করুন ।

সর্বশেষে একটি কথা মনে রাখবেন , আপনার জীবনের একটি মহান উদ্যেশ্য রয়েছে । আপনার জীবনে আপনিই সেরা । আর আপনি নিজেকে যতটা ভাবেন , তার চেয়েও বেশি ক্ষমতা আপনার আছে । নিজেকে আপনি যতটুকু স্মার্ট মনে করেন , তার চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট আপনি । আর যতটুকু কৃতিত্ব নিজেকে দিয়ে থাকেন তার চেয়ে অনেকগুন বেশি কৃতিত্ব ধারণের অধিকার আপনার রয়েছে । তাই এই কথাগুলো আপনি নিজেকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলবেন না । মনে রাখবেন আপনার চেয়ে আপন কেউ নেই আপনার , যে আপনাকে উজ্জীবিত করে তুলতে পারে।

আশা করি ইম্পোস্টের সিনড্রোম নিয়ে আমাদের লেখাটি আপনাদের ভালো লাগবে। ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটিতে যুক্ত থাকো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *