Student Zone

কাজী নজরুল ইসলাম – একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও সংগীতকার

3 Minute Read

কাজী নজরুল ইসলাম – এক বিস্ময়কর প্রতিভা

কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও দার্শনিক; যিনি বাংলা সাহিত্যে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাক্তিত্ব হিসেবে বিখ্যাত। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি ছিলেন। তাঁর কবিতা ও গান পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দুই বাংলাতেই সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহীতার পরিচয় থাকায় তিনি “বিদ্রোহী” কবি নামে আখ্যায়িত।

এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে নজরুল -এর জন্মগ্রহণ হয়। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। এক মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবেও কাজ করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি নাটক, কবিতা এবং সাহিত্য সম্মন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করার পর তিনি পেশা হিসাবে সাংবাদিকতাকে বেছে নেন। এসময় তিনি থাকতেন কোলকাতাতেই। এসময় তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন ব্রিটিশ রাজ্যের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহী এবং ভাগর গানের যত কবিতা; ধূমকেতুর মতো সাময়িকী প্রকাশ করেন। জেলে বন্দী হলে পরে লেখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী, এই সবে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। তাঁর সাহিত্যকর্মে ভালোবাসা, যুক্তি এবং বিদ্রোহ প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ধর্মীয় ভেদের বিরুদ্ধেও লিখেছেন। উপন্যাস, নাটক, ছোটোগল্প লিখলেও তিনি বিশেষত কবি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি নতুন ধারার জন্ম দেন বাংলা কাব্যে। এটি হল গজল তথা ইসলামি সংগীত এর সাথে তিনি শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। তিনি প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেছেন যেগুলো নজরুল গীতি নামে পরিচিত। মধ্য বয়সে তিনি আক্রান্ত হন পিকস ডিজিজে। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন ১৯৭২ সালে। এখানেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন :-

কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘দুখুমিয়া’। গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন তিনি। ১৯০৮ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৯ বছর। বাবার মৃত্যুর পর অভাব অনটনের কারনে তাঁর শিক্ষা জীবন ব্যাহত হয়। নজরুল মক্তব থেকে নিন্ম মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শুরু করেন শিক্ষকতা। হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের আথান দাতা হিসাবে কাজ শুরু করেন।

সৈনিক জীবন:-

১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরে নওশেয়ার থান প্রশিক্ষণের জন্য তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ সালের শেষভাগ -১৯২০ খ্রিঃ পর্যন্ত। তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোয়াল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম অংশ নেন বিশ্বযুদ্ধে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

কাজী নজরুল ইসলামের কৃতিত্ত্ব :-

কাজী নজরুল ইসলাম অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ইত্যাদি। অন্যদিকে উপন্যাস, ছোটোগল্প ও প্রবন্ধ রচনায়ও তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। তাঁর লেখা বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, ব্যাথার দান, রিক্তের বেদন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অপর দিকে নজরুল ছিলেন বাংলা গজল গানের স্রষ্টা।
অগ্নিবীণা কাব্যের কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা হল —
“প্রলয়োল্লাস” , ‘ আগমনী’ , ‘ খেয়াপারের তরণী ‘ , ‘ শাত-ইল্-আরব ‘ , ‘ বিদ্রোহী ‘, ‘কামাল পাশা ‘ ইত্যাদি।
সাম্যবাদী কাব্যের “নারী” কবিতায় নারী-পুরুষের সময়ের মূল মন্ত্রটি ধ্বনিত হয়েছে :

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।

যাবতীয় অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে তার তীব্র প্রতিবাদ “বিদ্রোহী” কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে-


আমি চির বিদ্রোহী বীর বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির !


সংগীতের জগতে বাঙালির হৃদয়ের আসনে চিরস্থায়ী আসন নজরুলের । তাঁর গানগুলি নজরুলগীতি নামে অভিহিত । প্রেম , প্রকৃতি , পূজা , ভক্তিরস , বিদেশি সুর , গজল , রাগ , হাসি দেশাত্মবোধ , সম্প্রীতি সমস্ত বিষয়েই নজরুল ইসলাম গান রচনা করে মুগ্ধ করে রেখেছেন আপামর বাঙালিকে । “নয়ন ভরা জল গো তোমার” , “শুকনো পাতার নূপুর পায়ে” , ” জাতের নামে বজ্জাতি সব “
” অরুনকান্তি কে গো যোগী “, ” অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে ” “গুল বাগিচায় বুলবুলি তুই” ইত্যাদি আরো অনেক অমর গানগুলি সর্বদা হৃদয়ে বাজে ।

অসুস্থতা :-

নজরুল বেতারে কাজ করেছিলেন , এমন সময় তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন ১৯৪২ সালে। তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানা যায় ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে। তার পরে তাঁকে মূলত হোমিওপ্যাথিক এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করা হয়। এতেও তেমন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেননি। ১৯৪২ সালে তিনি হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য। ১৯৫২ সালে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে কবিকে এবং কবি পত্নীকে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৫৩ সালের মে মাসে তাঁকে লন্ডনে পাঠানো হয়। লন্ডনে যাওয়ার পর বেশ কয়েকজন চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। রাসেল সেইনের মতে নজরুলের রোগটি ছিল দুরারোগ্য বলতে গেলে অসম্ভব ছিল আরোগ্য করা। ১৯৫৩ সালে ৯ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয়। এর থেকে জানা যায় যে, কবি পিকস ডিজিজ নামে একটি সমস্যায় ভুগছেন। শেষপর্যন্ত নজরুলকে ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসতে হয়।

আরও পড়ুন : বেগম রোকেয়া – নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ

বাংলাদেশে আগমন ও প্রয়াণ:-

১৯৭১ খ্রিঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ সালে ভারত সরকারের আদেশে নজরুলকে বাংলাদেশে আনা হয়। কবির বাকি জীবনটা বাংলাদেশেই কেটেছিল। এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও কবির কোন উন্নতি ঘটে নি। ১৯৭৪ সালে কবির সবচেয়ে ছোটো ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৬ সালে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে শুরু করে । এরপর কবির মহাপ্রয়াণের পর দুই বাংলার মানুষ শোকস্তব্ধ ও মুহ্যমান হয়ে পড়ে । তিনি বাঙালি-হৃদয়ে চির ভাস্বর এক নক্ষত্র — কাজী নজরুল ইসলাম ।

লেখাটি ভালো লাগলে সকলের সাথে শেয়ার কর। এরকম লেখার আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে যুক্ত থাকো।

হাসিনা পারভিন
Contributor

পরিচয়- দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠরতা ছাত্রী।
ভালোলাগে - বই পড়তে, গান শিখতে, নাচ করতে।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন - ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে থাকতে, গরীব-দরিদ্র মানুষের হাতে হাত মেলাতে, সঠিক পথ দেখাতে, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে থাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *