লিও টলস্টয়ের জীবনী ও বিখ্যাত বাণী ও উক্তি সমূহ। Leo Tolstoy Quotes
লিও টলস্টয়ের জীবনী ও বিখ্যাত বাণী ও উক্তি সমূহ
“Everyone thinks of changing the world, but no one thinks of changing himself.”
লিও টলস্টয় রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক; এমনকি তাকে বিশ্ব সাহিত্যেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জ্ঞানার্জনে অসীম আগ্রহী; অদম্য অনুসন্ধিৎসু, অফুরন্ত জীবনীশক্তির অধিকারী ও কর্মোদ্যমী এই বিখ্যাত মানুষটির জন্ম ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার টুলা প্রদেশে। টলস্টয়ের পুরো নাম কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ টলস্টয়। তিনি মানুষের মধ্যে জীবনবোধ, মনুষ্যত্ববোধ, নীতিবোধ জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। টলস্টয় তাঁর সময়ের বিশিষ্ট প্রগতিবাদী বৈপ্লবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ।
শিক্ষাজীবন:
পরিবারের চতুর্থ সন্তান ছিলেন টলস্টয়। শৈশবেই পিতা মাতার মৃত্যুর পর টলস্টয় তাঁর পিসির কাছে মানুষ হন। বাল্যকালে বাড়িতেই টলস্টয় এর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। মাত্র ৫- ৬ বছর বয়সে তিনটি ভাষায় তাঁর হাতেখড়ি হয়- মাতৃভাষা রুশ, জার্মানি এবং ফরাসি। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কাজান বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং প্রাচ্যদেশীয় ভাষা শিক্ষার ছাত্র হিসাবে পড়াশোনা আরম্ভ করলেও সাফল্য আসেনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কৃষক হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বাবার জমিদারিতে ফিরে আসেন।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সফল না হলেও তিনি রবীন্দ্রনাথের মতোই প্রকৃত অর্থে স্বশিক্ষিত ছিলেন। নিজের চেষ্টায় গ্রিক ,আরবি, লাতিন, ইংরেজি সহ বহু ভাষায় তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। চিত্রকলা এবং সঙ্গীতশাস্ত্রেও টলস্টয় পারদর্শী ছিলেন।
কর্মজীবন :
বেহিসাবি জীবন-যাপনে প্রচুর অর্থের অপচয় করে টলস্টয় তাঁর দাদার কাছে ফিরে যান। তাঁর দাদা নিকোলাই সৈন্যদলে চাকুরী করতেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তিনি ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। শিক্ষা শেষে ককেসাসের যুদ্ধে যোগদান ও করলেন। টলস্টয় রুশ সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ছিলেন। সৈন্যদলে টলস্টয় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। জীবনকে ভরে তোলেন নানান সব অভিজ্ঞতায়। এই সময়ই তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
সাহিত্যজীবন :
টলস্টয় সারা জীবন ধরে সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। টলস্টয় সম্পর্কে উনিশ শতকের ব্রিটিশ কবি ও সমালোচক মেথু আর্নল্ড বলেন, “টলস্টয় শুধু এক শিল্পকর্ম নয়, বরং জীবনের একটা অংশ।” তিনি যথার্থই বলেছিলেন। তিনি Art for Art sake বা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে, ‘সাহিত্য হবে জীবনের জন্য।’ তাই দেখা যায় তাঁর প্রতিটি সাহিত্য জীবন ও নীতিবোধ নিয়ে গড়ে উঠেছে। জীবন ও নীতিবোধ নিয়ে সম্পূর্ণ পরিষ্কার ধারণা গড়ে ওঠার পরই তিনি লেখায় হাত দিয়ে ছিলেন। টলস্টয়ের অধিকাংশ লেখায় অবাস্তব কল্পকাহিনী অনুপস্থিত। তাঁকে নিয়ে বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি বলেন, “টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী।” আন্তন চেখভ বলেছেন, “কত প্রতিভাবান একজন শিল্পী এবং মনস্তাত্বিক!!”
শুধু রুশ সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম সেরা লেখকই নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ও সাহিত্যক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন টলস্টয় প্রথম আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “Childhood” রচনা করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস হিসেবে সেটি ‘The Contemporary‘- তে প্রকাশিত হয়। সেনাবাহিনী ত্যাগ করার পর তিনি আত্মজীবনীমূলক ট্রিলজির দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড প্রকাশ করেন যথাক্রমে ‘Boyhood‘ ও ‘Youth‘ নামে। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘War and peace‘ প্রকাশিত হয়। সাহিত্য মহল এই কাহিনীতে গভীরভাবে আলোড়িত হয়। এরপর ১৮৭৩- ১৮৭৭ এর মধ্যে তাঁর ‘Anna Karenina‘ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোট উপন্যাস হল- ‘The death of Ivan llych‘ এবং ‘Father Sergius‘।
এগুলি ছাড়াও টলস্টয় প্রচুর ছোট গল্প যেমন ‘How much land does a man require?’ ,’The Three questions‘, ইত্যাদি এমনকি তিনি প্রবন্ধ এবং নাটকও লিখেছেন। জীবনের প্রকৃত অর্থ অনুসন্ধান এবং অতি সহজে ও সংক্ষেপে জীবনের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কিত বার্তা দেওয়াই তাঁর ছোটগল্পগুলির উদ্দেশ্য।
ব্যক্তিজীবন :
ব্যক্তিগত জীবনে টলস্টয়ের মধ্যে প্রচুর পরস্পরবিরোধী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। যুবা বয়সে তিনি যেমন একদিকে বেহিসাবি জীবন যাপন করে অর্থের অপচয় করেছেন, তেমনি প্রৌঢ়ত্ত্বে পৌঁছে সর্বত্যাগী সন্তের মত জীবন কাটিয়েছেন। তিনি ভাল শিকারিও ছিলেন। একবার একটা ভালুক তাঁর চোখের নীচে থাবা মারে, তাতে তাঁর বাঁ দিকের গাল ছিড়ে যায় এবং তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন ওই ভালুকটি কে মারতে। দুই সপ্তাহ পর আবার শিকারে যান এবং ভালুকটি বধ করেন। সমাজের প্রতি বন্ধু-বান্ধবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি যা উচিত মনে করতেন, যা ন্যায্য বরাবরই তাই করেছেন। খ্রিস্টান ধর্মযাজক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করে তিনি তাঁদের রোষের শিকার হন। তাঁকে খ্রিস্টধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি আর খ্রিস্টান বলে গণ্য হবেন না। এ কথার উত্তরে তিনি বলেছিলেন- যারা ঈশ্বর ও যীশু খ্রীষ্টকে নিয়ে ব্যবসা করে তিনি তাদের চেয়ে বেশি খ্রিস্টান। একইভাবে তিনি রাশিয়ার জার শাসনতন্ত্রের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও সরব হন। নিজের জমিদারিতে দরিদ্র চাষির ছেলে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করে তাতে নিজেও জড়িয়ে পড়েন। আইনের নামে কিভাবে প্রহসন হয় সে ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দিনের পর দিন আদালত আর জেলখানায় ঘুরেছেন। সাহিত্যে সেইসব অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ঘটেছে।
শেষ জীবন :
শেষ জীবনে তিনি কাউকে না জানিয়ে গৃহত্যাগ করেন। বাড়ি থেকে দূরবর্তী আস্টাপোভা নামক রেলস্টেশনে প্রচন্ড শীতে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর তিনি দেহত্যাগ করেন।খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক টলস্টয় বেঁচেছিলেন প্রায় ৮৩ বছর। এভাবেই বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক, রাশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ এই ঔপন্যাসিকের চলে যাওয়া। কিন্তু তিনি আজও অমর হয়ে আছেন তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।
চলচ্চিত্র :
২০০৯ সালে টলস্টয়ের জীবনের শেষ বছরের দিনগুলো নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ‘The Last Station‘ নামে। এই চলচ্চিত্রটি ‘Jay Parini ‘ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করা হয়।
জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ এই শিল্পী মানুষটির বাণী ও উক্তিগুলি তাই আমাদের নতুন করে জীবনের অর্থ উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে। নীচে
লিও টলস্টয়- এর কয়েকটি বিখ্যাত বাণী ও উক্তি সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হলো-
টলস্টয় এর অনুপ্রেরণামূলক কয়েকটি বাণী :
১.”প্রত্যেকেই বিশ্বকে বদলে দেওয়ার চিন্তা করে, কিন্তু নিজেকে বদলানোর চেষ্টা কেউ করে না।”- টলস্টয়
২.‘সবাই নিজের বুদ্ধিতে সন্তুষ্ট, কিন্তু কেউ নিজের অবস্থার ওপর সন্তুষ্ট নয়।’- টলস্টয়
৩.“ মানুষের সুখ আর পরিশ্রম তার জীবন গড়ে তোলে ”- টলস্টয়
৪.“ধৈর্য হলো জগতের সবচেয়ে শক্তিমান যোদ্ধা।”- টলস্টয়
৫.”ব্যক্তি হলো সেই ভাগফলের মতো যার লব সে নিজে আর হর হলো নিজের ব্যাপারে সে যা ভাবে। হর যত বড়, ভাগফল তত ছোট।” -টলস্টয়
৬.”যদি তুমি সুখী হতে চাও, হও।” -লিও টলস্টয়
৭.”জীবনের একমাত্র অর্থ মানবতার সেবা করা।”- টলস্টয়
৮.”বেশিরভাগ লোক কোনো কাজ করছে বলেই বেঠিক কাজ ঠিক হয়ে যায় না। “- লিও টলস্টয়
৯. “যেখানে কোন সরলতা, ধার্মিকতা এবং সত্য নেই, তার কোনও মহিমা নেই।”- লিও টলস্টয়
১০.”ছোট্ট পরিবর্তনেও জীবন সত্যি করে জীবন্ত হয়ে ওঠে।”-লিও টলস্টয়
১১.”আপনি যদি পরিপূর্ণতার সন্ধান করেন তবে আপনি কখনই সন্তুষ্ট হবেন না।”- লিও টলস্টয়
১২.”আমরা হেরে যাই কারণ আমরা আমাদের নিজেদের বলেছি যে আমরা হেরে গেছি।”-লিও টলস্টয়
১৩.”কথা ও কাজের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল কথা সর্বদা মানুষের উদ্দেশ্যে তার সম্পর্কের উদ্দেশ্যে , কিন্তু কর্ম মাত্রই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে করা সম্ভব।” – লিও টলস্টয়
ভালোবাসা নিয়ে লিও টলস্টয়ের কয়েকটি উক্তি :
১৪.”আমি যা বুঝি সবই আমি বুঝতে পারি কারণ আমি ভালবাসি।”- লিও টলস্টয়
১৫. “একমাত্র প্রেমেই বিয়েকে পবিত্র করতে পারে। আর একমাত্র অকৃত্রিম বিয়ে হচ্ছে সেটাই, যেটা প্রেমের দ্বারা পবিত্রকৃত। “-টলস্টয়
১৬.”কাউকে ভালোবাসলে, আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী কেমন হতে পারতো সেটি ভেবে নয়। বরং তারা যেমন আছে সেই অবস্থাতেই ভালোবাসুন।”- লিও টলস্টয়
১৭.”ভালোবাসা যেখানে থাকা উচিত ছিলো, সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে সম্মান উদ্ভাবন করা হয়েছে। “- লিও টলস্টয়
১৮.”একজন যুবকের জন্যে বুদ্ধিদীপ্ত নারীর সঙ্গ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। “- লিও টলস্টয়
সুখ নিয়ে টলস্টয় – এর কিছু বাণী :
১৯.”সুখ বাহ্যিক বস্তুসমূহের উপরে নির্ভর করে না। নির্ভর করে সেগুলোর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপরে।”
২০.”পৃথিবীর প্রতিটি সুখী পরিবার একই রকমভাবে সুখী, প্রতিটি অসুখী পরিবার নিজের নিজের ধরণে অসুখী।’’ – টলস্টয়
২১.”সুখী হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে যে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেকার সংযোগ কখনোই ভাঙা যাবে না।”-লিও টলস্টয়
শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে টলস্টয় -এর কিছু উক্তি :
২২.”শিল্প মানুষকে নিরপেক্ষভাবে, আনন্দের সাথে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেকে মানুষের সেবায় আত্মত্যাগ করতে বাধ্য করতে পারে।”-লিও টলস্টয়
২৩.”ইতিহাস লেখকগণ হচ্ছেন বধির লোকেদের মত তারা এমন সব প্রশ্নের জবাব বের করতে থাকেন যা কেউ জানতে চায়নি।”- টলস্টয়
২৪.”সকল মহৎ সাহিত্য দুই ধরণের গল্পের একটি; এক ব্যক্তি ভ্রমণে বের হয় অথবা আগন্তুক শহরে আসে।” -লিও তলস্তয়
২৫. “শিল্প পুরুষদের মধ্যে মিলনের একটি মাধ্যম, একই অনুভূতিতে তাদের একসাথে যোগদান।”- টলস্টয়
২৬.”শিল্প হস্তশিল্প নয়, শিল্পী যে অনুভব করেছেন তা অনুভবের সংক্রমণ। “- লিও টলস্টয়
মৃত্যু নিয়ে টলস্টয়ের উক্তি :
২৭.”মৃত্যু, সবকিছুর অনিবার্য পরিণতি, প্রথমবারের মতো অপ্রতিরোধ্য শক্তি দিয়ে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল।”
শত্রু সম্পর্কে লিও টলস্টয় – এর উক্তি :
২৮.”শত্রুর কাছ থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে ভালোবাসো।”
আশা করি লিও টলস্টয় নিয়ে লেখাটি ভালো লাগবে। ভালো লাগলে বাকিদের সাথে শেয়ার করো। আমাদের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটি লাইক করো।
Article By – Ferdousi Manjira