শিক্ষা ও জীবন

কীভাবে এল বাংলা নববর্ষ এসো জেনে নিই ।

3 Minute Read

এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।

” এসো হে বৈশাখ এসো এসো …” সবার প্রিয় কবির এই বিখ্যাত গানের মাধ্যমে বাংলায় বরণ করে নেওয়া হয় নববর্ষকে । ১লা বৈশাখ নতুন জামা কাপড় , অনুষ্ঠান , উন্মাদনা আর রবিঠাকুর সব মিলিয়ে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে বাঙালি ।
আরে হ্যা …. নতুন বছর , নতুন খুশি , নতুন দিশা আর সঙ্গে অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা আগাম জানাই আমাদের সকল বন্ধুদের ।
তোমরা কি জানো কবে থেকে আর কীভাবে এই বাংলা বছর চালু হলো ? আর কীভাবেই বা ১লা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপনের সূত্রপাত হলো । তাহলে এসো জেনে নিই ১লা বৈশাখ আর নববর্ষের আসল ইতিহাস । h

Image Source : Flickr

আজ থেকে ৪৬৩ বছর আগের কথা । মুঘল আমলে সারা দেশেই বছর গণনা হতো হিজরি সন অনুযায়ী । আর এই হিজরি সন এ মাস গণনা হয় চন্দ্রমাস অনুযায়ী । যার ফলে ২৮দিনে মাস শেষ হত । আর প্রতি বছর শুরু হতো এক এক ঋতুতে । অর্থাৎ বছরে একই মাসে ঋতু বদল ঘটে যেতে থাকলো । কৃষি প্রধান বাংলায় খাজনা আদায় করতে গিয়ে সমস্যা হতো । এক এক বার এক এক ঋতুতে খাজনা আদায়ের চাপ আসতে থাকলো । কোনো বার হেমন্ত তো কোনো বার গ্রীষ্ম ঋতুতে ।

এই অসুবিধা দূর করতে সম্রাট আকবর জ্যোতির্বিজ্ঞানী পণ্ডিৎ ফতেউল্লাহ সিরাজিকে নির্দেশ দেন বাংলায় নতুন বর্ষপঞ্জির ব্যবস্থা করতে ।

ইতোমধ্যে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে বাংলায় ফসল কাটার সময় অর্থাৎ হেমন্তকাল থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হতো সারা বছরের খাজনা পরিশোধ করে দেবার জন্য ।

আবার বাংলায় রাজার রাজত্বে এতদিন ধরে বছর গণনা করা হত শকবর্ষ হিসেবে । যেখানে চৈত্র মাসকে শুরু ধরা হতো । অর্থাৎ আজকের বৈশাখ মাস ছিল বাংলা শকাব্দের দ্বিতীয় মাস । আকবরের সিংহাসনে আরোহনের সময় থেকেই চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা পরিশোধের বিধান দেওয়া হয় । আর এই সনের নাম দেওয়া হয় ফসলি সন । আজকের বৈশাখ থেকে চৈত্র এই যে বছর এর সূত্রপাত সেটা এই ফসলি সনকেই বলা যায় ।

এইবার চলে আসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজি কি করলেন তার কথায় । ফতেউল্লাহ সিরাজি বাংলায় প্রচলিত শকবর্ষ ( যেখানে বাংলা বারো মাসের নাম পাওয়া যায় ) অর্থাৎ হিন্দু সৌর সন আর আরবি হিজরি সন কে মিলিয়ে বাংলা সন বিনির্মাণ করেন । যার সন গণনা শুরু হয় ইংরেজি হিসেবে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০বা ১১ ই মার্চ থেকে । হিজরি সনের হিসেবে ছিল ৯৯৩ হিজরি ৮ই রবিউল আউয়াল । আর হিসেব টানা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহনের দিন থেকে । অর্থাৎ ৯৬৩ চন্দ্র সনকে ধরা হয় ৯৬৩ বঙ্গাব্দ । সেই হিসেবে বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জির বয়স হয় মাত্র ৪৬৩ বছর । মানে বাংলা বঙ্গাব্দ ১ থেকে শুরু হয় নি , শুরু হয়েছিল ৯৬৩ থেকে । ৯৬৩ হিজরি চন্দ্রমাসের প্রথম মাস ছিল মহররম । আর তখন ছিল বৈশাখ মাস । আর তাই চৈত্র মাসের বদলে তখনই বৈশাখ থেকে বাংলা বর্ষ গণনা শুরু করা হয় ।

আর সম্রাটের নির্দেশ থাকে চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যেই খাজনা মাশুল সব পরিশোধ করে দিতে হবে । আর ১লা বৈশাখ থেকে হিসেবের নতুন খাতা খোলা হবে । সেই থেকেই বাংলার ভূস্বামীগণ নিজের প্রজাদের মিষ্টি বিতরণ করতেন ও হালখাতা খুলতেন । যা এখন ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলা ও মিষ্টি মুখ করানোর মধ্যে প্রচলিত আছে । আর বর্তমানে হালখাতায় যে ” এলাহী ভরসা” লেখা হয় , তার উৎস ধরা হয় ‘ দিন-ই-ইলাহী’ কে ।

এতো গেল কীভাবে বাংলা নববর্ষ এল ও কিভাবে ১লা বৈশাখ পালনের সূত্রপাত ঘটল তা জানলাম । কিন্তু আধুনিক নববর্ষ পালনের বিষয়টিও জেনে রাখা দরকার । কেননা সারা বিশ্বে বাংলার ১লা বৈশাখ ( ১৪বা ১৫ই এপ্রিল ) নববর্ষ উদযাপনের বিষয়টিকে সেরা লোকউৎসবের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে । হালখাতা , মেলা , মঙ্গল শোভাযাত্রা , পান্তাভাত খাওয়া , দুইপারের বাংলায় সরকারি ছুটি , নতুন জামা কাপড় আর উপহার দেওয়া প্রভৃতি নানা রকমের আয়োজনে বাংলা ও বাঙালি মেতে ওঠে । আধুনিক নববর্ষ পালনের সূত্রপাত ঘটে ১৯১৭ সালে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সাফল্য কামনা করে হোম , পূজা , কীর্তন প্রভৃতির মাধ্যমে। আর বর্তমান ১লা বৈশাখ দিনটিকে সমারোহে পালনের সূচনা হয় ১৯৬৭ সালে । আর ১৯৭২ সালে বা বাংলা ১৩৭৯ সন পহেলা বৈশাখ দিনটি বাংলাদেশের জাতীয় পার্বণ হিসেবে স্বীকৃত হয় । সেইসঙ্গে ইংরেজি বর্ষপঞ্জির সঙ্গে দিনের হিসেব মেলাতেই সূর্যোদয়ের পরিবর্তে রাত ১২ টার পর নতুন দিন , তারিখ গণনার নির্দেশ দেয় বাংলা একাডেমি ১৪০২ সনে ।

আর বাঙালি , সে তো উৎসব প্রিয় বরাবরই । তাই বারো মাসে একশো তেরো পার্বণ পালন করে উৎসব মুখর বাংলা যে ১লা বৈশাখে নব বর্ষের সাজে সেজে উঠবে … একথা বলাই বাহুল্য । এখন তো আবার উৎসবের ডিজিটাল ফর্মে ঘরে বসেই সকলে উৎসবের অংশীদার হওয়া যায় । সঙ্গে কবির ওই প্রিয় গানটি … ” এসো হে বৈশাখ এসো এসো ….”

বন্ধুরা নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা নিও । আর লেখাটি ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের শেয়ার করে তাদেরকেও বিষয়টি জানার সুযোগ করে দাও । খুব ভালো থেকো , সুস্থ থেকো । আমাদের ফেসবুক পেজ এ সঙ্গে থেকো । নতুন বছরে নতুন নতুন লেখা তোমাদের জন্যই অপেক্ষায় থাকবে ।

ধন্যবাদ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *